Header Ads

ভারতের দিল্লীতে অবস্থিত রহস্যময় এক লোহার পিলার


কথায় বলে সারা বিশ্ব ঘুরে দেখতে চাও তবে ভারত ঘুরে দেখো। কারণ সমগ্র বিশ্বে যেসকল বিস্ময় লুকিয়ে আছে তার এক একটি প্রতিচ্ছবি ভারত তার বুকে আকড়ে রেখেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ সৌন্দর্য, সম্পদ, পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদি দিক থেকে বিশ্বে অনন্য সমগ্র ভারত জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য প্রত্নতাত্নিক সম্পদ ও স্থাপনামূলত মুসলিম রাজা-বাদশাহদের বসবাস এবং তাদের রাজত্বের কারণে ভারত নানা দিক থেকে সম্পদশালী হয়েছেভারতে অনেক পুরাতন স্থাপনা আছে যেগুলো বিস্ময়কর, দৃষ্টি নন্দন ও রহস্যময়আর তেমনই একটি রহস্যময় স্থাপনা হচ্ছে লোহার পিলার ভারতের রাজধানী দিল্লীতে রয়েছে একটি বিস্ময়কর লোহার পিলার। যেটি শতবর্ষ ধরে দাড়িয়ে আছে কিন্তু এটি কোথা থেকে এসেছে এবং কে নিমার্ণ করেছে সেটা আজও অজানা। আর তাই এই লোহার পিলারটি সবার কাছে এক বিস্ময়।

দিল্লী লোহার পিলারের অবস্থান:


রহস্যময় এই লোহার পিলারটি ভারতের রাজধানী দিল্লীর ঐতিহাসিক কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে অবস্থিত। ১৬০০ বছরের পুরাতন এই পিলারটি পরিপূর্ণ খাটি লোহায় তৈরি। যার উচ্চতা ২৩ ফুট ৮ ইঞ্চি বা ৭.২১ মিটার। পিলারের গোঁড়ার দিকে ব্যাস ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি, সরু মাথার মাপ ২৯ সেন্টিমিটার এবং পিলারটির মোট ওজন ৬ টন। পাথরটির ভিত্তি সীসা দিয়ে ঢালাই করা একটি গোল গ্রিডের উপর অবস্থিত। ১৯৯৭ সালে ভারত সরকার এই পিলারকে ক্ষতি সাধনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এটিকে একটি লোহার গ্রিল দ্বারা বেষ্টন করে দেয়। রহস্যময় এই পিলারে বিভিন্ন তারিখ সম্বলিত অনেক গুলো শিলালিপি এবং গ্রাফিতি খোদায় করা আছে। প্রায় ১৬০০ বছর পার হয়ে আসলেও এখনও এই শিলালিপি এবং গ্রাফিতি গুলো অক্ষত অবস্থায় আছে। পিলারটি তৈরি করা হয়েছে লোহার টুকরো একত্রিত করে ফোরজ ওয়েল্ডিং পদ্ধতি অবলস্বন করে।


ভারতের বিখ্যাত আইআইটি বিশেষজ্ঞ বালাসুব্রামনিয়াম বলেন এই পিলারে বিশেষ এক ধরনের মরিচা প্রতিরোধন ব্যবহার করা হয়েছে যার কারণে লোহার এই পিলারটি এতো বছর পরও মরিচা ধরেনি। এই পিলারে প্রচুর পরিমানে ফসফরাস ব্যবহার করা হয়েছিল ফলে বিভিন্ন ঋতুর আবহওয়া এই পিলারটি সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত যখন যে ঋতু আসুক না কেন, কোনও ঋতুই এই লোহার পিলারে কোনও ক্ষতি সাধন করতে পারেনা। স্ফটিক ফসফেট দিয়ে এই এই পিলারের সমগ্র ধারে এমনভাবে একটি আস্তরণ তৈরি করা হয়েছে যে, হাজার ঝড় বৃষ্টি ও রোদ উপেক্ষা করে গত ১৬০০ বছরে এই পিলার ১ মিলিমিটার পুরত্ব থেকে মাত্র ২০ ভাগের একভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। লোহার এই পিলারের মাথায় রয়েছে নিপূণ ভাবে কারুকায করা একটি ফলক। যেটিতে ৬ থেকে ৭টি স্তরের কারূকার্য করা হয়েছে অনেক দক্ষতার সাথে। পিলারটির মাথার ফলকে কোনও গোপন অর্থ বা সংকেত আছে কিনা সেটি আজও গবেষণা করে জানা সম্ভব হয়নি।

পিলারটির মাঝ বরাবর স্থানকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। উপর থেকে নীচের মাঝ বরাবর ১৩ ফুটের অংশটি অনেক তাৎপর্য বহন করে। কারণ, ঠিক মাঝ বরাবর স্থানে অনেক গুলো গোলার আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় ১৭৯৯ সালে নাদির শাহ যখন দিল্লী আক্রমণ করেন তখন তিনি এই লোহার পিলারটিকে ধ্বংস করে ফেলার নিদ্র্েশ দেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন পিলারটি হিন্দু দেবতাদের উৎসর্গ করে তৈরি করা। পিলারটি ধ্বংস করার জন্য একে লক্ষ্য করে কামানের গোলা ছুড়লেও পিলারটিকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। নাদির শাহের সৈন্যদের গোলার আঘাতে পিলারটি ধ্বংস না হলেও এর শরীরে গোলা লাগার বেশ কিছু গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। গোলার আঘাতে পিলারটি ধ্বংস করা যাচ্ছে না দেখে নাদির শাহ পরবর্তীতে এটি ধ্বংস না করার সিদ্ধান্ত নেন।

আমি আগেই বলেছি রহস্যময় লোহার পিলারটি দিল্লীর কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে অবস্থিত। কুতুব মিনার ভারতের আরও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। কুতুব মিনার ভারতের একটি দর্শনীয় স্থান। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সারা বিশ্ব থেকে এটি দেখতে আসে। কুতুব মিনারকে কেন্দ্র করে এই সমগ্র এলাকাটি নিয়ে একটি কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে এবং তার মাঝেই ঠিক কুতুব মিনারের সামনেই রয়েছে রহস্যময় এই লোহার পিলারটি। এবার আসুন আমরা ঐতিহাসিক কুতুব মিনার সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে জেনে আসি।

ভারতে যেসকল ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে কুতুব মিনার তাদের মধ্যে অন্যতম। কুতুব মিনার নির্মাণ কার্য শুরু করেছিলেন কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯২ সালে এবং এটি সমাপ্ত করেন ১২২০ সালে তার জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ। ১৩৮৬ সালে মিনারটির উপরের দিকের কয়েকটি তলার নির্মাণ কাজ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক। এই মিনারটির উচ্চতা ৭৩ মিটার বা ২৩৯.৫ ফুট। ৫ তলা বিশিষ্ঠ এই টাওয়ারের প্রতিটি তলা ১৪.৩ মিটার বা ৪৭ ফুট এবং এটিতে ৩৭৯ পদক্ষেপের একটি সপিৃল সিড়ি রয়েছে। ধারনা করা হয় এই মিনারটি আফগানিস্তানের মানারত জামে মসজিদের অনুকরণে তৈরি করা হয়। 

মিনারের চারপাশে কমপ্লেক্স এর মধ্যে আরও বেশি কিছু ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান আছে, যার মধ্যে রয়েছে কুয়াত আল ইসলাম মসজিদ এবং একটি গম্বুজ। এই গম্বুজটিকে আবার বলা হয় স্মিথ ফলী। এই সকল স্থাপনা গুলো সবই কুতুব মিনার নির্মাণের সময়ে নির্মাণ করা হয়। সেখানের এই শিলালিপি থেকে জানা যায় ইলতুৎমিশ এই মিনারটি তৈরি করার সময়ে ২৭টি হিন্দু ও জৈন মন্দিরের জিনিসপত্র ভেঙ্গে ফেলেছিলেন এবং সেটা ব্যবহার করে মিনারের উপরের ৩টি তলা নির্মাণ করেন।

টাওয়ারটি এবং তার পাশে অবস্থিত মসজিদটি আফগানিস্তানের স্থাপত্য নকশায় তৈরি করা হয়েছিল এবং এখানে প্রতিটি স্থাপনার গায়ে অনেক সুন্দরভাবে নকশা খোদায় করা হয়েছিল। আরবি ভাষা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় এই অলংকরণ এবং শিল্প কর্ম দেখে দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হন। ১৯৭৪ সালে ভারত সরকার এই টাওয়ারের সিড়ি বেয়ে দর্শকদের উপরে উঠার সম্মতি দেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৪ ডিসেম্বর এই সিড়ির রেলিং ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে ৪৭ জন নিহত এবং আরও শতাধিক দর্শনার্থী আহত হয়। তারপর থেকে ভারত সরকার এই মিনারের সিড়ি বেয়ে উঠা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইউনেস্কো সমপ্রতি এই টাওয়ারকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে।

রহস্যময় লোহার এই পিলারটি ঠিক কিভাবে তৈরি হয়েছিল বা পিলারটির কিভাবে উদ্ভব হয়েছিল এবং কি রহস্য রয়েছে এই পিলারের মাঝে সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতোবিরোধ আছে তবে সবাই এক বাক্যে এই কথা স্বীকার করে যে এটি ভারতীয় সহ বিশ্ববাসীর কাছে একটি সম্পদপ্রতি বছর দেশী-বিদেশী হাজার হাজার দর্শনার্থী ও পর্যটক এই পিলারটি দেখতে আসেন

গবেষকরা ধারনা করেন পিলারটি চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর দিকে স্থাপন করা হয়প্রায় ১৬০০ বছরের মতো সময় অতিবাহিত হলেও পিলারটির গঠনশৈলীর এতটুকু বিকৃত হয়নি পিলারটি এমন এক সুচারু প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়েছে যে, আজও এতে কোনও মরিচা ধরেনি কিংবা ক্ষয় হয়নিপিলারটি নির্মাণের সময় বিশেষ প্রক্রিয়ায় চাপ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং এতে ব্যবহার করা হয়েছে শতকরা ৯৮ ভাগ খাঁটি লোহা

প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি অংশের ধারণা, হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর পতাকা খোদিত এ পিলারটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে ৩৭৫খ্রিঃ-৪১৪ খ্রিস্টব্দের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসবীদগন অনেক গবেষণার পর বলেছেন এই পিলারটি তৈরি করেছিলেন গুপ্ত বংশীয় রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কোনও মন্দির নির্মাণে বা মন্দির চত্বরে স্থাপনের জন্যই পিলারটি তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু এটি কিভাবে বর্তমানের কুতুব মিনার কমপ্লেক্স এসেছে সেটি এক অজানা রহস্য।

অবশ্য কেউ কেউ ধারণা করেন, কুতুব-উদ্দিন আইবেক মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য এটি কোনও মন্দির থেকে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেনকিন্তু এই ধারনারও কোনও দালিলিক প্রমাণ নেইলোককাহিনী মতে, পিলারটি অলৌকিকভাবেই কুতুব কমপ্লেক্সে চলে এসেছে, কেউ এটিকে এখানে নিয়ে আসেনি আবার অনেকের মতে অদৃশ্য শক্তিতে পিলারটি এখানে আসার পরে এই পিলারকে কেন্দ্র করে কুতুব-উদ-দীন এই কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন ভারতের অনেক ঐতিহাসিক বলেন, পিলারটি এখানে আসার পূর্বে পিলারটিকে অন্য অনেক জায়গায় দেখা গেছেইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকরা বলেন, গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা কুমারা গুপ্ত এটি তৈরি করেনআর এটি নির্মাণের সময়কাল ছিল ৩২০-৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই পিলারের গায়ে খোদায় করা অবস্থায় একটি ফলকে এর ইতিহাস লেখা আছেকিন্তু লেখাগুলি কেউ অনুবাদ করতে পারছিলেন না দীর্ঘদিন ধরেপরিশেষে ১৮৩৮ সালে জেমস প্রিনচিপ নামক এক ভারতীয় ব্যক্তি এই লেখাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেনসেই তথ্য মতে, এই পিলারটির নির্মাতা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য


৩৭৫খ্রিঃ-৪১৪ খ্রিঃ মধ্যে তিনি এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে তিনি ধারনা করেছিলেন। নির্মাণের পর এটি বিষ্ঞুপাদাগিরিতে সর্বপ্রথম স্থাপন করা হয়গুপ্ত বংশের শাসনের সময় এখানে জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা দেয়া হতোসেখানে এই পিলারের ছায়া দ্বারা শিক্ষা প্রদান করা হতো জ্যোতির্বিদ্যা শিখতে আসা ছাত্রদের। তবে অনেক ঐতিহাসিকগন এই মতবাদকে গ্রহণ করেননি। অনেকে বলেছেন এই টাওয়ারটি কোনও ভাবে কুতুব মিনারের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে, অথবা এটি অলৌকিকভাবে এখানে স্থাপিত হয়েছিল।

রহস্যময় পিলারটি দেখতে এসে পর্যটকরা এর গায়ে হেলান দিয়ে বা একে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলে থাকেঅনেকে আবার এটির গোঁড়ায় এসে বন্ধুত্ব তৈরি করেবিশেষ করে ভারতে অনেক হিন্দু আছে যারা কল্যাণ কামনায় এই পিলারটিকে পূজা করে থাকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে শিক্ষা সফরে আসে এবং ১৬ শতকের ভারতের ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করে। তবে সাধারণভাবে এটি দেশী-বিদেশী সকল মানুষদের কাছে দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপনা এবং ঐতিহাসিক একটি স্থান ২০০৬ সালের হিসেবে এটি ছিল ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় এলাকা। শুধু ২০০৬ সালেই এটি দেখতে এসেছিল ৪০ লাখ মানুষ, যা ছিল সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলকে দেখতে আসা দর্শনার্থীদের চেয়েও বেশি।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.