Header Ads

শত বছরের রহস্যে ঘেরা নিউপোর্ট টাওয়ার - রহস্যের হাতছানি


আমাদের এই মহাবিশ্বে রহস্যময় স্থানের কোনও শেষ নেইবিশ্বে রহস্যময় যেসকল স্থান রয়েছে তার অধিকাংশই রহস্যময় হয়েছে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের কারণেবিশেষ করে প্রাচীন আমলে তৈরি করা এমন অনেক প্রাসাদ বা স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে যেগুলোর প্রকৃত ইতিহাস আজও জানা যায় নি, ফলে এই সকল বাড়ি বা স্থাপনাগুলো আজও সবার কাছে এক রহস্য আর তেমনই রহস্যময় একটি স্থাপনার নাম নিউপোর্ট টাওয়ার নিউপোর্ট টাওয়ারটি আরও কয়েকটি নামে পরিচিত, যার মধ্যে রয়েছে রাউন্ড টাওয়ার, নিউপোর্ট স্টোন টাওয়ার বা ওল্ড স্টোন মিলআজকে আমি আপনাদের এই টাওয়ারের ইতিহাস এবং এর রহস্য নিয়ে আলোচনা করবো।

নিউপোর্ট টাওয়ারটি বিশ্বের এক রহস্য। কি কারণে এটি নির্মাণ করা হয়েছিলো অথবা কি কাজে এই টাওয়ারটি ব্যবহৃত হতো সেটি আজও অজানা। আবার এই টাওয়ারকে ঘিরে রয়েছে অনেক বিচিত্র কল্প কাহিনী। টাওয়ারের ইতিহাস ও রহস্য জানবো আমরা একটু পরে, তার আগে চলুন নিউপোর্ট টাওয়ারের সংক্ষিপ্ত তথ্য জেনে আসি।

নিউপোর্ট টাওয়ারের অবস্থান: 


গোলাকার আকৃতির প্রাচীন এই টাওয়ারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোদ দ্বীপের নিউপোর্ট এলাকার টাউরো নামক স্থানে অবস্থিতএই টাওয়ারটি সম্পূর্ণ পাথরের তৈরিবিখ্যাত এই টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয় ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়েটাওয়ারটি উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকে এর ব্যাস ২২ ফুট ২ ইঞ্চি এবং পূর্ব-পশ্চিম দিক থেকে এর ব্যাস ২৩ ফুট ৩ ইঞ্চিটাওয়ারটির উচ্চতা মোট ২৮ ফুটএক সময় এই টাওয়ারের দেয়ালগুলো সাদা প্লাস্টার করা ছিলবর্তমান সময়েও বাহিরের দেয়ালে তার কিছু নমুনা দেখা যায়সমস্ত টাওয়ারটি আটটি কলামের উপর দাড়িয়ে আছেযার মধ্যে দুটি কলাম অন্য ছয়টি কলামের চেয়ে আকারে বড়কলামগুলোর গায়ে ডোরাকাটা দাগে অঙ্কন করা হয়েছে নানা প্রজাতির প্রাণীর ছবি, নাম ও আরও অনেক কিছু টাওয়ারের দেয়ালগুলো শক্ত ও পুরু করে তৈরি করাএর প্রতিটি দেয়াল ৩ ফুট পুরু এবং টাওয়ারটির অভ্যন্তরের ব্যস প্রায় ১৮ ফুটএই টাওয়ারে মোট ৭টি জানালা রয়েছেযার মধ্যে টাওয়ারের অভ্যন্তরে রয়েছে চারটি জানালা এবং এর উপরের স্তরে রয়েছে ছোট আরও তিনটি জানালা এই টাওয়ারের পাশে ছোট-বড় আরও কিছু টাওয়ার রয়েছেযে টাওয়ারগুলো বিভিন্ন সময়ে তৈরি করা হয়েছে

 ১৭৪১ সালের তথ্য মতে এই টাওয়ারটি ব্যবহৃত হতো পাথরের মিল হিসেবে, ১৭৬৭ সালে এটি পাউডারের মিল হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং আমেরিকান বিপ্লবের সময় এই টাওয়ারকে ব্যবহার করা হয়েছিল ক্যাম্প ও ওয়াচ টাওয়ার হিসেবেআমেরিকান বিপ্লবের পর থেকে এই টাওয়ারকে রহস্যময় টাওয়ার বলা হয় জিম ব্রানডন নামক একজন আমেরিকান গবেষক ও প্রকৌশলী নিউপোর্ট টাওয়ারকে কেন রহস্যজনক টাওয়ার বলা হয় এর কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেন

নিউপোর্ট টাওয়ারের ইতিকথা:


ব্রানডন প্রাচীন এই টাওয়ারের নানা উপকরণ, লেখা, কারুকার্য নিয়ে প্রায় ১ বছর গবেষণা করে দেখেছেন যে, নিউপোর্ট টাওয়ারটি যে পাথর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে তা প্রাচীন চুম্বক জাতীয় পাথর এই চুম্বক জাতীয় পাথরের গায়ে রয়েছে চৌম্বক ক্ষমতা যা সহজেই লৌহ জাতীয় পদার্থকে আকৃষ্ট করতে পারেম্যাগনেট ছাড়াও টাওয়ারের ৩য় ও ৪র্থ তলায় পাওয়া গিয়েছিল মানুষের পায়ের চিহ্ন, প্রাচীন নকশা এবং মানুষের মাথার খুলিএই সকল বিষয় থেকে অনুমান করা হয় যে, প্রাচীনকালে বা আমেরিকান বিপ্লবের সময় এই টাওয়ারটিতে মানুষদের একত্রিত করে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতোএমনকি কোনও ব্যক্তিতে শাস্তি দিতে হলে তাকে এখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হতো ১৯৪৬ সালে অধ্যাপক পি লভফোল্ড নামক একজন গবেষক সুইডেন, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ড নরওয়েতে ১৪ ফুট উচ্চতার একই ধরনের টাওয়ারের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন যার মধ্যে স্কটল্যান্ডের টাওয়ারটি তৈরি করা হয়েছিল ১১১৫ সালে এবং নেদারল্যান্ডেরটি তৈরি করা হয়েছিল ১১৬০ সালে

নিউপোর্ট টাওয়ারের সঙ্গে এই টাওয়ারগুলোর মিল থাকায় পৃথিবী ব্যাপি একই ধরনের টাওয়ার কি কারণে প্রাচীনকালে তৈরি করা হয়েছিল সে ব্যাপারে গবেষকদের মাঝে রহস্যের সৃষ্টি করেছেতবে সাধারণ মানুষদের এই টাওয়ার সম্পর্কে উৎসাহের শেষ নেই। অতি উৎসাহী অনেক জনগন বলে থাকেন গভীর রাতে এই টাওয়ারে কান পেতে থাকলে শোনা যায় দূর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে আবার অনেকে দাবী করেন গভীর রাতে নিউপোর্ট এলাকায় যদি বিদ্যুৎ না থাকে তবে এই টাওয়ারে মৃদু মৃদু আগুন জ্বলতে দেখা যায়। নিওপোর্ট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন এমন অনেক বাসিন্দা ধারনা করেন প্রতিরাতে এই টাওয়ারের চারপাশে এখানে নিহতদের আত্নাগুলো ঘুরে বেড়ায়।

রহস্যময় নিউপোর্ট টাওয়ারটি তৈরি করেন রোদ দ্বীপের প্রথম গভর্নর বেনেডিক্ট আর্নল্ড ব্রিটিশ পেনি ম্যাগাজিন ১৮৩৬ সালে বর্ণনা করে নিউপোর্ট টাওয়ারের মতো একই ধরনের একটি টাওয়ার ইংল্যান্ডের চেস্টারটনে আছেবেনিডিক্ট জন্ম গ্রহণ করেন লিমিংটন শহরে যে শহরটি ছিল চেষ্টারটনের নিকটেফলে তিনি ওই টাওয়ারের অনুকরণে এই টাওয়ারটি সহজে নির্মাণ করতে পেরেছিলেনতিনি এটি তৈরি করেছিলেন মূলত পাথরের মিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য।  

১৮৪৮ সালে ড. জ্যাকসন এই এলাকাটি ভ্রমণ করেন এবং তিনি সেখান থেকে যুদ্ধে ব্যবহৃত কয়েকটি মর্টার এবং প্রাচীন স্থাপত্যের অনেক নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পান এই টাওয়ারটি শেল চুন, বালি এবং নুড়ি দিয়ে তৈরি করা, যেমনটি ছিল ১৬৪০ সালের ইস্টন হাউজ এবং গভর্নর আরনল্ড এবং তার স্ত্রীর সমাধী সৌধ। ১৮০০ সাল থেকে ১৯০০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই টাওয়ারটি এক প্রকার অযত্ন ও অবহেলায় পড়েছিল।

১৯৪৮ সালে আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে এই টাওয়ারের বিষয়ে গবেষণার অনুমোতি দেয়া হলে হারভাট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই টাওয়ারকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। এই গবেষণার প্রধান ছিলেন উইলিয়াম এস গডফ্রে। প্রায় তিন বছর ধরে খনন কার্জ ও গবেষনার পর ১৯৫১ সালের শেষের দিকে উইলিয়াম এস গডফ্রে গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করেন এবং তিনি বলেন এই টাওয়ারটি ১৭ শতকের দিকে তৈরি করা এবং তিনি নিশ্চিতভাবে জানান যে এই টাওয়ারের নির্মাতা ছিলেন বেনেডিক্ট আরনল্ড।

বিশিষ্ঠ ঐতিহাসিক থমকিনস এই টাওয়ারের বিষয়ে আরও বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য প্রদান করেন। তিনি বলেন আসলে এই টাওয়ারটি যিনি নির্শাণ করেছিলেন তার নাম ছিল আরনল্ড এবং তার পিতার নাম ছিল বেনেডিক্ট। তার পিতার সম্পদ এবং সুনামের কথা বিবেচনা করে তিনি তার নামের পূর্বে তার পিতার নাম সংযুক্ত করে নেন। ১৬৫০ সালের হিসেবে তার সম্পদের হিসাব ধরা হয়েছিল ৫ পাউন্ড এবং এটিই ছিল তৎকালিন সময়ে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক হিসাব। তিনি এই টাওয়ারটি নির্মাণ করেছিলেন সেখানে একটি পাথরের মিল তৈরি করার জন্য। অবশ্য উইলিয়াম গডফ্রে এই মিল তত্ত্বটিকে একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে আরনল্ড এই টাওয়ারটি মোটেও পাথরের মিল তৈরি করার জন্য নির্মাণ করেন নি। বরং তিনি এটি নির্মাণ করেছিলেন এখানে এসে সময় কাটানো এবং চিত্ত বিনোদনের জন্য। গডফ্রে তার কথার প্রমাণ হেসেবে বলেন ১৮ শতকের আগে ইংল্যান্ডে ধোয়া তৈরি করে এমন কোনও মিলের প্রচলন ছিলো না বললেই চলে। বিখ্যাত উইন্ড মিল বিশেষজ্ঞ রেক্স ওয়েল্স পরে আবার এই টাওয়ারটি খুব ভালভাবে গবেষণা করেন এবং তিনি থমকিনসের মতামতকে প্রাধান্য দেন এবং তিনিও বলেন আরনল্ড এই টাওয়ারটি নির্মাণ করেছিলেন একটি মিল তৈরি করার জন্য।

১৮৩৭ সালে ডেনিশ পুরাতত্ত্ববীদ কার্ল ক্রিস্টিয়ান এই টাওয়ারটি নিয়ে গবেষণা করেন এবং তার মতে এই টাওয়ারটিতে অনেক জোত্যিবিদ্যা লুকিয়ে আছে। ইউনিভার্সিটি অব রোদ আইল্যান্ডের এক প্রফেসর তার কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে এই টাওয়ারের জোত্যিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন এবং এই টাওয়ারের বৈশিষ্ঠ দেখে তারা এটিকে একটি দিক নির্ণায়ক কম্পাস হিসেবে বর্নণা করে। তাদের গবেষণা প্রকাশ পেলে এই টাওয়ারকে সবাই নতুনভাবে চিনতে শুরু করে। টাওয়ারের ৮টি পিলারের মধ্যে ৪টি পিলার এই কম্পাসের মেইন পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়েছে। গ্রীষ্মকালে যখন সূর্য উঠে, তখন চকচকে আলো ছড়িয়ে পড়ে এই টাওয়ারের পশ্চিম জানালা দিয়ে ভিতরে দক্ষিন পাশের দেয়ালে। ঠিক একই ভাবে পূর্ব জানালা দিয়ে রোদ ঢুকে পশ্চিম দেয়ালে এসে আলো ছড়িয়ে পড়ে। এর পরের জানালাগুলোও ঠিক এমন ভাবে সাজানো যাতে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়া দেখে দিক নির্ণয় করা যায়।

লেখক গ্যাভিন মেনিজেস যুক্তি দেখিয়েছেন যে, চীনারা যে বছর আমেরিকা আবিস্কার করেছিলো সেই বছর তারা এই টাওয়ারকে সমুদ্র পথের বাতিঘর হেসেবে ব্যবহার করেছিলো। তারা এই টাওয়ার ব্যবহার করে আবার পৃথিবীর দ্রাঘিমা হিসাব করতো এখান থেকে।

বর্তমানে রোদ দ্বীপের যেখানে এই টাওয়ারটি অবস্থিত সেটিকে এখন বলা হয় নেউপোর্ট টাওয়ার পার্ক। টাওয়ারটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘোষণা দেয়ার পর এই টাওয়ারটিকে বর্তমানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। প্রতি বছর সমগ্র বিশ্ব থেকে হাজার হাজার মানুষ এটিকে দেখতে আসে। রাতের বেলা টাওয়ারটিকে বর্ণিল কৃত্তিম আলো দিয়ে সাজানো হয়। এখানে নিমার্ণ করা হয়েছে একটি যাদুঘর, যেটিতে নিউপোর্ট টাওয়ারের ইতিহাস এবং এর অনেক পুরাতন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

সমম্ত পার্কটি সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন এবং এর সীমানার মধ্যে রয়েছে গোলাকার একটি বৃত্ত এবং তার চারদিকে রয়েছে ৬টি পায়ে হাটার পথ। টাওয়ারটির চারপাশে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য রয়েছে বেশ কিছু গাছ। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নরওয়ে ম্যাপেল, পিন ওকস, ডগ উডস, এবং কালো বাদাম। রহস্যময় এই টাওয়ারের পাশে রয়েছে একটি ব্রোঞ্চ মূর্তি। যেটিকে বলা হয় Channing Statue. এটি উইলিয়াম ইলেরারির একটি মূর্তি। ১৮৯৪ সালে ইউনিয়নবাদী ধর্মতত্ত্ববিদ উইলিয়াম এলারি চ্যানিংয়ের জন্মের স্মরণে গির্জার মুখোমুখি একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে জাপান সরকার পেরির উদ্বোধনের শতবর্ষ উপলক্ষে এটি নিউপোর্ট টাওয়ার পার্কের কর্তৃপক্ষকে উপহার দিয়েছিলো।

নিউপোর্ট টাওয়ারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন একটি স্থাপনাফলে এই স্থাপনাকে ঘিরে মার্কিনদের রয়েছে বিশেষ আগ্রহ প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই দর্শীয় স্থাপনাটি দেখতে আসে। বিশ্বে একই ধরনের স্থাপনা কয়েকটি স্থানে থাকার কারণে অনেকে এটিকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকেনতবে এই স্থাপনাকে কেন্দ্র করে কোনও রহস্য আছে কিনা কিংবা কেনো এই টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল সেটি আজও এক রহস্যহয়তো এমন হতে পারে তৎকালীন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই অনুকরণে পাথরের মিল তৈরি করা হতো, অথবা এই টাওয়ার রোমহর্ষক কোন ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে পৃথিবীর বুকে আজও দাড়িয়ে আছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.