Header Ads

স্বাধীনতার মহান স্মারক স্মৃতি সৌধ

আমাদের এই বিশ্ব জগতে প্রায় দুই শতাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলো প্রত্যেকে সময়ের বিবর্তনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র বা উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে। তবে এই স্বাধীনতা লাভ করার দিক থেকে এমন কিছু বিরল রাষ্ট্র রয়েছে যাদের স্বাধীনতাকে যুদ্ধ করে রক্তের বিনিময়ে ক্রয় করে নিতে হয়েছে। বিশ্বের বুকে তেমনই একটি রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা হয়েছে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের দেশের ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্মৃতি চিহ্ন বা সৌধ নির্মাণ করে থাকে। বাংলাদেশও তাদের থেকে ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখার জন্য বাংলাদেশেও রয়েছে বিভিন্ন শহীদ স্মৃতি স্মারক। যার মধ্যে প্রধান স্মারকটির নাম স্মৃতিসৌধ

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানের অংশে পড়ে বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থান। তখন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বছরের পর বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাঝে মারাত্মক ক্ষোভের সঞ্চার করে। তারা দিনের পর দিন পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করে আসলেও পাকিস্তান সরকার ছিল উদাসীন। 

চরম ক্ষোভের মধ্যে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগন সরকারের  বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন পাকিস্তান সরকারের চরম বিরোধিতা শুরু করে তখন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালী জনগণের উপর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। 

পাক হানাদার বাহিনীর এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে ২৬ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবীতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। অনেক চরায় উতরায় পাড়ি দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদ ও হাজার হাজার নারীর সতীর্থ্য বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করে। আর সেই সাথে বিশ্বের বুকে আবির্ভূত হয় নতুন এক রাষ্ট্র, যার নাম বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণে বাংলাদেশ সরকার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারে নবীনগরে প্রায় ৮৪ একর জায়গা নিয়ে শহীদ স্মৃতিসৌধের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয় । সে সময় ২৬ লাখ টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ ও সড়ক নির্মাণের কাজ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ চলে।

এ সময় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা খরচ করে গণকবরের এলাকা, হেলি-প্যাড, গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান, চত্বর ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শহীদ মেজর জিয়াউর রহমান স্মৃতিসৌধটির নির্মাণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্মৃতিসৌধের নকশা নির্বাচনের জন্য তিনি স্মৃতিসৌধের নকশা প্রতিযোগিতাআয়োজন করেনসেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সেরা চিত্রকরদের আকা সেরা ৫৭ টি নকশার মধ্য থেকে স্মৃতি সৌধের জন্য স্থপতি সৈয়দ মইনুল  হোসেনের নকশাকে নির্বাচন করা হয়। 

১৯৮২ সালের মহান বিজয় দিবসের অল্প কিছু দিন পূর্বে শেষ  হয় মূল স্মৃতি সৌধের নির্মাণ কাজ। এর জন্য ব্যয় করা হয় আনুমানিক ৮৪৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকাএরপর তৈরি করা হয় কৃত্রিম লেক, সবুজ বেষ্টনী, ক্যাফেটেরিয়া, রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা ইত্যাদি। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত প্রকল্প অনুযায়ী এখানে একটি অগ্নিশিখা, সুবিস্তৃত ম্যুরাল এবং একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হয়। বিদেশী সরকার প্রধান, রাষ্ট্রদূত, বা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন স্মারক চিহ্ন হিসেবে সেখানে বৃক্ষ রোপণ করে থাকেন। 

এখন বর্তমানে ২৪ একর এলাকা ব্যাপী পরিবেষ্টন করে রয়েছে বৃক্ষরাজির বলয় । জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেওয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়াল গুলো ছোট থেকে বড় এই ক্রমে সাজানো। সাত জোড়া এই দেয়াল গুলো স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি পর্যায় কে নির্দেশ করে । যেগুলো হলো- ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ গন অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্মৃতি সৌধের সর্বোচ্চ বিন্দু ১৫০ ফুট উঁচু। স্থপতি মইনুল হোসেনের তৈরি সৌধের মূল কাঠামোটি কংক্রিটের এবং কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা লাল ইটের তৈরি। এটা করা হয়েছে মূল সৌধের গাম্ভীর্য ও স্বতন্ত্র রক্ষার জন্যলাল ইটের দ্বারা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লক্ষ প্রাণের রক্তকে নির্দেশ করা হয়েছে। পুরো কমপ্লেক্সে রয়েছে কৃত্রিম জলাশয়, বাগান এবং গণকবর 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর  বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এক বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এই স্থানে এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া এর আগে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গ্রাম থেকে অসংখ্য গ্রামবাসীদের রে নিয়ে এসে এই স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যার পর পাক হানাদার বাহিনী এই স্থানের নিচু জমিতে মৃত দেহগুলো মাটি চাপা দিতো। যুদ্ধের পরযখন এই এলাকা আবিষ্কৃত হয় তখন এটিকে বদ্ধ ভূমি ও গণকবর হিসেবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। 

এই গণকবর গুলো বর্তমানে স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের ভিতরে অবস্থিত। জাতীয় স্মৃতিসৌধের  মূল কাঠামোর সামনেই রয়েছে জলাশয় । আর এবং জলাশয় থেকে মূল কাঠামো এবং জাতীয় পতাকা প্রতিফলিত হয়। এই জলাশয়ে ফুটে থাকে অসংখ্য জাতীয় ফুল শাপলা।

সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে আজও আর মাথা উঁচু করে বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশীরা বীরের জাতি তারা কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। প্রতি বছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধের পাদদেশে হাজার হাজার বাংলাদেশী একত্রিত হয় এবং তারা স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। স্মৃতিসৌধকে সামনে রেখে আজও বাংলাদেশীরা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার শপথ গ্রহণ করে থাকে। তাই স্মৃতিসৌধ আজ বাংলাদেশীদের সাহস সঞ্চারের প্রধান উৎস।

1 টি মন্তব্য:

  1. ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা হয়েছে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ??
    ৩০ লক্ষ শহীদ মানে ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে ১৯৭১ সালে। এই সংখ্যার কোন বাস্তবতা আছে?? না কি দেশের লোক জন বলে তাই বলেন? দেশের লোক জন বা নেতারা যদি মিথ্যা বলে, তাহলে আপনিও কি মিথ্যা বলবেন?? আসলে এই সংখ্যাটি ১ লাখ পার হবে না। ১৯৯৬-৯৭ সালে এইটা নিয়ে একটু গননা হয়েছিল তাতে দেখা যায় ৭০-৮০ হাজারের মতো হয়। তখনই আ'লীগ সরকার এই হিসাবের বিষয়টা নিয়ে চুপ হয়ে যায়। তারা ভাবে আমাদের বড় নেতার মুখ দিয়ে বেরোয়ে গেছে ৩০ লাখ, আর এখন যদি ১ লাখ হয় তাহরে নেতার মর্যাদা থাকবে না। এই চিন্তা করে আ'লীগ চুপ থাকে। কিন্তু দিখে না যে এটা একটা তথ্যনির্ভর বিষয়।

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.