Header Ads

জনপ্রিয় বনের রাজা টারজান !

বিশ্বব্যাপী এমন অনেক জনপ্রিয় কাল্পনিক কাহিনী রয়েছে যেগুলো পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে উদ্ভব হলেও সেটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়। আর এই কাল্পনিক কাহিনীগুলোকে বিভিন্ন সিনেমা, নাটক, টিভি সিরিয়াল, গল্প, উপন্যাস, কার্টুনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে এমনভাবে জনপ্রিয় করা হয়েছে যে ছোট-বড় থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও এই কাহিনী সম্পর্কে অবগত। আর তেমনই একটি কাহিনী হচ্ছে টারজান কাহিনী। অবশ্য বিশ্বব্যাপী সবাই এই কাহিনীকে বনের রাজা টারজান বলে বেশী চেনে।

টারজান শব্দের অর্থ 'সাদা চামড়া'টারজান চরিত্রটির রচয়িতা বিশিষ্ট লেখক এডগার রাইজ বারোজ । টারজান চরিত্রটি মূলত রচনা করা হয়েছে পূর্ব আফ্রিকাকে কেন্দ্র করে। ১৯১৪ সালে এডগার রাইস বারোজ টারজান সিরিজের প্রথম উপন্যাস 'টারজান অব দ্য এপস' প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে এই চরিত্রটি। ১৯১৮ সালে প্রথমবারের মতো টারজান চরিত্রকে ঘিরে সিনেমা তৈরি করা হয়। যেটি এই চরিত্রকে আরও বেশী জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। ১৯২৯ সালে হ্যারল্ড ফস্টার এই টারজান চরিত্রটিকে নিয়ে কমিকস নির্মাণ করেন। মূলত এরপর থেকে এই চরিত্রকে পিছনে তাকাতে হয় নি। সময়ের সাথে স্রোতের বেগে টারজান চরিত্রের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে বিশ্ব জুড়ে।

টারজান চরিত্রের গল্পটি ছিল এরকম। ব্রিটিশ অফিসার লর্ড গ্রেস্টোক পশ্চিম আফ্রিকার কোন এক ব্রিটিশ উপনিবেশে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর জুলুমের অভিযোগ তদন্ত করতে তিনি আফ্রিকা সফরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে সমুদ্রেই তাঁর জাহাজে বিদ্রোহ দেখা দেয়। একসময় নাবিকরা তাকে মেরে ফেলে। সেই জাহাজে থাকা এক ইংরেজ দম্পতিকে তাদের শিশু সন্তান সহ জাহাজের নাবিকেরা আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে জোর করে ছেড়ে দেয়। জঙ্গলে নামিয়ে দেওয়ার পর সেখানে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একসময় সেই দম্পতি
মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় ২২ নভেম্বর ১৮৮৮ সালের বৃহস্পতিবার জন্ম নেওয়া তাদের ছয়-সাত মাস বয়সী একটি শিশু। 

বাবা-মাকে হারিয়ে শিশুটি যখন মাটিতে পড়ে কাঁদছিল তখন বনের মধ্যে থেকে এসে কয়েকটি গরিলা সেই শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। শিশুটিকে যে গরিলাটি তুলে নিয়ে গিয়েছিল তার নাম ছিল কালা। কালা নামের এই গরিলার আদরে ও তত্ত্বাবধানে বনের মাঝে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে শিশুটি। গরিলারা শিশুটির নাম দেয় 'টারজান' বা 'সাদা চামড়া'। কারণ শিশুটির গায়ের রং ছিল ফর্সা। দীর্ঘ দিন বনের অভ্যন্তরে পশুদের সাথে বেড়ে উঠার ফলে শিশুটির স্বভাব-চরিত্রও পশুদের মতো হতে থাকে। ধীরে ধীরে এক সময় সেই শিশুটি হয়ে উঠে শক্তিশালী এক যুবক। গাছের লতা ধরে সে এ গাছ থেকে ও গাছে ঘুরে বেড়ায়, মুখ দিয়ে বিচিত্র আওয়াজ করে আর পশুদের সাথে কথা বলে। বাঘ, সিংহ, কুমির, সহ বিভিন্ন পশুদের সাথে সে জঙ্গলে বসবাস করে আবার সেই সঙ্গে দরকারে তাদের সাথে লড়াইও করে। 

এই ভাবে ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে বনের রাজা টারজান। ঘটনাক্রমে কোনও এক সময় বাল্টিমোরের সুন্দরী মেয়ে জেন পর্টার ঘুরতে যান সেই বনে এবং তার সাথে দেখা হয়ে যায় টারজানের। সেই পরিচয় থেকে জানা-বোঝা ও একসময় তাদের মধ্যে গাড় বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। আর এই বন্ধুত্বের ফলে পর্টার বুঝতে পারে টারজানের মধ্যে কোন মানবীয় গুণেরই উপস্থিতি নেই। শিশু বেলা থেকে জঙ্গলে পশুদের সাথে বড় হওয়ার কারণে সে নিজেকে পশু হিসেবেই ভাবে। সেই মেয়েটি এক সময় টারজানকে আস্তে আস্তে সভ্য সমাজের নিয়ম-কানুন শেখানো শুরু করে। আধুনিক সভ্য সমাজের সাথে তাকে মিলিয়ে মিশিয়ে আধা পশু -আধা মানুষ এবং এক সময় তাকে সভ্য মানুষ বানিয়ে নতুন জীবন দান করে। তারা উভয়ে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন। টারজানের ঔরসে জন্ম গ্রহণ করে দুটি সন্তান, যাদের নাম ছিল জন পল ও ক্লাইটন ওঠ আকা কোরাক। আর এভাবেই এগিয়ে চলে বনের রাজা টারজানের গল্প।

টারজান গল্পটি যেমন সবার কাছে জনপ্রিয় তেমনি এই নামটির উদ্ভবেও রয়েছে কাহিনী। প্রায় শতাধিক বছর আগে লেখক এডগার রাইস বারোজ 'টারজান' গল্পটি লেখেন। তিনি গল্পটি লিখতে খুব বেশী সময় নেন নি। অল্প
সময়ে গল্পটি লেখার পর তিনি ভাবতে থাকেন গল্পের  চরিত্রটির নাম নিয়ে। কি নাম দেওয়া যায় এ বনের রাজার! অভিনব একটি নাম দরকার, যা সবাই পছন্দ করবে। তিনি ভাবতে থাকেন দিন-রাত। লেখকের এমন অবস্থা দেখে তার পালক মা গল্পটির নাম দেন 'জানটার' যার অর্থ 'সাদা ত্বক'। কিন্তু লেখকের এই নামটি পছন্দ হয় নি। তিনি এমন একটি নাম চাচ্ছিলেন যে নামটি শিশুদের কাছে খুব পছন্দনীয় ও তাদের উচ্চারণে সহজ হয়। শেষ পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মায়ের দেওয়া নামটাই উল্টে দিয়ে গল্পের চরিত্রের নাম ঠিক করেন 'টারজান'। 

নিউইয়র্কের 'ইভনিং ওয়ার্ল্ড' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো 'টারজান' গল্পটি। আর ১৯১৪ সালের জুন মাসে 'টারজান অব দ্য এপস' নামে প্রথম টারজানের বই বাজারে আসে। পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেই বই ক্রয়ের জন্য। তখন এর দাম ছিল মাত্র দুই ডলার। মূল বইয়ের মোট পর্ব সংখ্যা ছিল ২৬টি। ১৯১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি 'টারজান অব দ্য এপস'-এর প্রথম শো হয় নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটারে। সে সময় হলিউডের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম ফিল্ম, যা লক্ষাধিক ডলার ব্যবসা করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৩১ সালে 'টারজান' সাদাকালো দুনিয়া ছেড়ে সানডে কালার কমিক্সে চলে আসে। ওই বছরই বিশাল বাজেট নিয়ে মেট্রো গোল্ড উইন মেয়ার টারজানের প্রথম গল্পটিকে সিনেমায় রূপ দান করেন। 

বিখ্যাত টারজান গল্পের লেখক এডগার রাইস বারোজ ১৯৫০ সালে মারা যান। কিন্তু তিনি মারা গেলেও থেমে থাকেনি টারজানের কাজ। তার কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক টিভি সিরিয়াল, সিনেমা, কার্টুন, ভিডিও এবং কম্পিউটার গেমস। সিনেমা জগতে টারজান কতটা পরিচিত শব্দ সেটা একটি পরিসংখ্যান দেখলেই জানা যায়। ১৯১৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে টারজানের উপর ৮৯টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল লোকই টারজান সম্পর্কে অবগত। একবার হলেও টারজানের নাম শোনে নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আর এর মাধ্যমেই বোঝা যায় টারজান চরিত্রটি সমগ্র বিশ্বে কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। টারজান বিশ্বে এতটাই জনপ্রিয় যে, এখন শত শত বছর হয়তো টিকে থাকবে টারজান ও এর জনপ্রিয়তা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.