Header Ads

বৈচিত্র্যময় চাকমা বিবাহ রীতি !

শুভ বিবাহ। প্রত্যেক সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামাজিক কাঠামোকে সঠিকভাবে ধরে রাখার জন্য ও সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখার জন্য বিয়ের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বিভিন্ন রাষ্ট্র, সমাজ বা ধর্ম ভেদে বিবাহের রয়েছে পৃথক নিয়ম। তবে সাধারণভাবে বিবাহ প্রত্যেক সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মে একটি উৎসবের নাম। বর-কণের মিলনের এই দিনে পরিবারের সদস্যসহ প্রতিবেশীরাও মিলে থাকে আনন্দ উৎসবে। নানান সমাজের নানান বিবাহ উৎসবের মধ্যে চাকমাদের বিবাহ অন্যতম। বরং তাদের বিবাহ উৎসব কিছুটা ব্যতিক্রমী।

চাকমা বাংলাদেশে বসবাসকারী একটি উপজাতি গোষ্ঠী। বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে চাকমা সবচেয়ে বৃহত্তম উপজাতি। যাদের বসবাস চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন জেলায়। বাংলাদেশে বাঙ্গালি ও উপজাতিদের মধ্যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আর তারই সূত্র ধরে চাকমাদের বিবাহের অনুষ্ঠানে রয়েছে নানান বৈচিত্র্য

বিবাহ যোগ্য চাকমা পাত্রের জন্য তার অভিভাবকরা নিজে এবং নিকটাত্মীয় মারফত পছন্দনীয় পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে থাকে। চাকমা ভাষায় এ প্রস্তাব পাঠানোকে বলা হয় 'উদা লনা'বর পক্ষ যখন কণের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় তখন সাথে করে উপহার হিসেবে মদ, পান-সুপারি, নারিকেল, শুঁটকি, পিঠা প্রভৃতি নিয়ে যায়। পাত্রীপক্ষের জবাব ইতিবাচক হলে শুরু হয় পরবর্তী পর্ব। বিয়ের ব্যাপারে উভয়পক্ষের মতামত হয়ে যাওয়ার পর বিবাহের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। 

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করার পর কোনও পক্ষ বিয়েতে অসম্মতি জানালে অপর পক্ষকে ক্ষতি পূরণ দিতে হয়। চাকমা ভাষায় এ ক্ষতিপূরণের নাম 'লাজভার'চাকমাদের নিয়ম অনুযায়ী দু'পক্ষের বিয়েসিদ্ধান্ত হওয়ার পর সেই পাত্রীকে অন্য কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চাকমারা কনে দেখাকে তাদের ভাষায় বলে 'বউ চা যানা'বিয়েতে কন্যাপক্ষের ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর দু'পক্ষ নির্ধারিত একটি দিনে আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করে খাওয়া দাওয়া করে। 

বিয়ের নির্ধারিত দিনের পূর্বে রয়েছে পাত্রীপক্ষের পণ নির্ধারণের অনুষ্ঠান। যাকে বলা হয় 'দাভা' িবাহের পণ হিসেবে সাধারণত বর পক্ষ নগদ টাকা, চাল, দ্রব্যসামগ্রী, শূকর প্রভৃতি কণে পক্ষকে দিয়ে থাকে। বর পক্ষের পণ দেওয়ার অনুষ্ঠানকে বলে 'উবোর খজ্জি'পণের ব্যাপারে আলোচনার জন্য দ্বিতীয়বার কন্যাপক্ষের বাড়িতে বর পক্ষ গেলে তাকে বলা হয় 'দ্বিপুর' যার অর্থ দ্বিতীয় সফর। দ্বিতীয় পর্যায়েও যদি উভয় পক্ষের সিদ্ধান্ত না হয় তবে তৃতীয়বার বর পক্ষের গমনকে মদ পিলাং গজানি বলে। উভয় পক্ষের মতামত সাপেক্ষে বিয়ের তারিখ ঠিক করাকে বলা হয় 'থক দরা যানা'

চাকমা সমাজে বিয়ের অনুষ্ঠান কয়েকটি পর্বে বিভক্ত। বউ আনতে যাওয়া বরযাত্রীকে বলা হয় 'বউ হজা যেয়ে'। আর বউকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার দলকে বলা হয় 'বউ বারে দিয়া'। বউ তোলার অনুমতি পাওয়ার পর বরের ছোট ভাই বা বোন বা বরের নিকটাত্মীয় একজন বাড়ির মূল প্রবেশপথে পিঁড়ি পেতে কনের পা ধুইয়ে দেয়। এরপর বরের মা অথবা অন্য একজন সধবা প্রবেশপথের দু'পাশে রাখা দুটি কলসির গলায় বাধা সাত প্রস্থ সুতা কেটে কনের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে বেঁধে দেন। এরপর বউকে নিয়ে যাওয়া হয় ফুল ঘরে। বধূবরণ অনুষ্ঠানে বাড়ির সদর দরজায় দু'টো পানি ভর্তি কলস রাখা হয়, সেগুলোর নাম 'মঙ্গল কলসি'। 

এই মঙ্গল কলসির ঢাকনার পর মোমবাতি বা সলতে জ্বালানো থাকে কলসির গলায় বাঁধা সুতা কেটে দেওয়ার পর অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে কনেকে ঘরে তোলা হয়। চাকমাদের বিবাহের মূল অনুষ্ঠানের নাম চুমুলাং 'চুমুলাং' অনুষ্ঠানে একজন পুরোহিত থাকেন। চুমুলাং বা বিয়ের অনুষ্ঠানে একই বেদীতে দুটি পূজার ঘট বসানো হয়। সেখানে বরের জন্য চাল ও কনের জন্য দেওয়া হয় ধান। চুমুলাংয়ে একটি শূকর, তিনটি মুরগি বা মোরগ ও মদ উৎসর্গ করতে হয়। চাকমাদের বিশ্বাস মতে চুমুলাংয়ের দেবী হলেন পরমেশ্বরী।

চাকমাদের বিয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের নাম 'জদনবানাহ্''জদনবানাহ্'র অর্থ বর-কনের জোড়া বাঁধা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বর-কনে সমাজে বর-বউ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। নবদম্পতির জন্য সাজানো একটি কক্ষে বরের বামে কনেকে বসিয়ে বরের বড় ভগ্নীপতি সম্পর্কীয় একজন উচ্চৈঃস্বরে বিয়েতে উপস্থিত জনমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে বলেন, 'অমুক আর অমুকের জদনবানাহ দিবার উঘুম আঘেনে নেই'। 

সবাই উচ্চৈঃস্বরে 'আছে-আছে' বলে স্বীকৃতি দেওয়ার পর সেই ব্যক্তি সাত হাত লম্বা এক টুকরা কাপড় দিয়ে বর-কনের উভয়ের কোমরে জড়িয়ে বেঁধে দেন। আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্নের পর এই বাঁধন আবার খুলে দেওয়া হয়। উপবিষ্ট বর-কনে তখন যার যার আসন থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। তাদের সমাজে এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, আসন থেকে যে আগে উঠতে পারে সেই সারাজীবন অপরজনের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারে।

চাকমা বিয়ের আরেকটি পর্ব 'খানা সিরানা বা খানা সিরেদেনা'। এর অর্থ সমাজের দায় শোধ করা। বিয়েতে সমাজের স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে বর সমাজের কাছে ঋণী হয়। এই ঋণ বা দায় শোধ করতে সে বাধ্য। সেই হিসেবে বিয়েতে সামর্থ্য অনুসারে বর পক্ষকে একটি সামাজিক খানা দিতে হয়। এই খানায় 'টক' জাতীয় একটি বাধ্যতামূলক তরকারি থাকে, যাকে চাকমা ভাষায় 'খাদা' বলা হয় এই অনুষ্ঠানে বর-কনে মদের বোতলসহ রান্না করা মোরগ ও শূকরের মাংস একটি মেজাংয়ের উপর ঢাকনা দিয়ে সাজিয়ে বৃত্তাকারে আসীন সবাইকে প্রণাম করে পরিবেশন করে যারা বিয়েতে 'খানা সিরিনা' পর্ব সমাপ্ত করে না তাদের মৃত্যু হলে সমাজের লোকেরা তাদের শ্মশানে নেওয়ার সময় কাঁধের উপরে করে নেওয়ার বদলে নিচে করে নেয়।

বিয়ের কাজ সমাপ্ত হওয়ার পরের দিন বর ও নববধূকে কনের পিতার বাড়ি যেতে হয়। এ যাওয়ার নাম 'বেষুত ভাঙা''বেষুত ভাঙা' সম্পন্ন করা অপরিহার্যকোনও কারণে কনের বাড়িতে বেষুত ভাঙা করতে না পারলে নিকটাত্মীয় কারও বাড়ি গিয়ে অথবা তাও সম্ভব না হলে চিরসবুজ ছায়া যুক্ত গাছের ছায়ার তলে বেষুত ভাঙার কাজ সম্পন্ন করতে হয়।

চাকমা সমাজে বিয়েতে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের পর্ব বহু বছর ধরে চলে আসছে, আজকাল আধুনিক চাকমা সমাজে এই সকল রীতি-নীতির অনেক কিছুই এদিক-ওদিক করতে দেখা যায়। চাকমা সমাজে ঘর জামাই থাকার প্রচলনও দেখা যায়। সেক্ষেত্রে বিয়ের অনুষ্ঠানের অনেক নিয়ম-কানুন ব্যতিরেকে বিয়ে পড়ানো হয়।

৪টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.