Header Ads

ভারতীয় উপমহাদেশে রোজার বিবর্তন !

মাহে রমজান সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য এক মহিমান্বিত মাস। মহিমান্বিত এই মাসে সিয়াম পালন করার মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করে। মহান আল্লাহ তায়ালা রসূল (সাঃ) এর সময়ে মুসলমানদের উপর রমজান মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। সেই সময় থেকেই বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রমজানে একমাস রোজা পালন করে।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম থেকেই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের বসবাস। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে এখানে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। প্রথম দিকে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে তেমন জানতো না। ফলে তারা ইসলামের বিধান সমূহকে সঠিকভাবে পালন করতে পারতো না। মাহে রমজান মাসে তৎকালীন সময়ের মুসলমানরা অনেক ভুল-ত্রুটির মধ্য দিয়ে রোজা পালন করতো। বর্তমান সময় মুসলমানরা তাদের রোজার নিয়মগুলো জানলে হয়তো হাস্যকর মনে করবে কিন্তু এগুলো ছিল বাস্তব।

ভারতীয় উপমহাদেশে যখন প্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে তখন সিয়াম বা রোজা পালনের বিষয়টি মানুষের মাঝে তেমন উৎসাহব্যঞ্জক ও ব্যাপকতর ছিল নাতৎকালীন সময়ে মুসলমানদের মাঝে ঈদ ও রোজা যতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল তার চেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল কারবালার ঘটনাটি। কারণ এই ঘটনাটি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের অনেক পরে সংঘটিত হয়েছিল এবং ঘটনাটি হৃদয় বিদারক হওয়ার কারণে এর প্রচার ও প্রসার ব্যাপকতর হয়েছিল। 

তাই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মুহররমকে উৎসবের সাথে পালন করতো। তৎকালীন সময়ে ভারতের হিন্দুরা বছরে ১৩ থেকে ১৫টি বা তার চেয়ে বেশী উৎসব পালন করতো সেজন্য মুসলমানদের মধ্যেও উৎসব পালনের দিকে বেশী উৎসাহ ছিল। আর তখন মুসলমানের সংখ্যা কম থাকার কারণে রোজা ও ঈদ এগুলো ছিল তাদের কাছে সাদামাটা বিষয়।

মুসলিম আবির্ভাবের অল্প কিছু দিন পরই অবশ্য এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইসলামী অনুষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে আরব ও অনারব মুসলিমরা ব্যবসা বাণিজ্য  উপলক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন। তাদের সঙ্গে সূফী-দরবেশ ওলী-আউলিয়া ও ধর্ম প্রচারক গনও আসতেন তারা এখানে এসে মানুষদের মাঝে ইসলাম প্রচার করতেন। আরব থেকে আসা এসব মানুষদের জীবন যাপন থাকতো সহজ সরল। তারা ঈদ ও রোজা পালন করতো ধর্মীয় আবরণে সীমাবদ্ধ থেকে। 

পরে ধীরে ধীরে এ অবস্থার আরও পরিবর্তন ঘটে সে সময় ইরানীরাই ছিল শিক্ষা দীক্ষায় সবচেয়ে উন্নততাই ইসলামী কালচার এ ধারক ও বাহক হিসেবে তাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতোমূলত তাদের মাধ্যমেই ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতকের দিকে সিয়াম পালন ব্যাপকতা লাভ করে এখানের মুসলিম সমাজেহিন্দু ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠানের প্রভাবে প্রভাবিত ইসলামী অনুষ্ঠানগুলো সে সময় অতটা স্বাধীন ও উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। 

তখন এখানের মুসলমানরা নতুন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে ধর্মীয় বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানুনে তাদের তেমন জ্ঞান ছিল না। ইসলাম ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতেও হিন্দু রীতির আধিপত্য ছিল লক্ষণীয়তখন অধিকাশ মুসলমান ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে এতোটাই অজ্ঞ ছিল যে, তারা জানতো না কীভাবে নামাজ আদায় করতে হয়

ভারতীয় উপমহাদেশের নতুন মুসলমানরা রোজা সম্পর্কে খুব ভাল ভাবে কিছু জানতো না। রোজা পালনের নিয়ম, বিধি-বিধান সম্পর্কে তাদের ভাল ধারনা
ছিল না। রোজা কখন শুরু করতে হয়, কখন শেষ করতে হয়, কি কারণে রোজা নষ্ট হয় ইত্যাদি কোনও বিষয়েই তাদের সঠিক কোনও জ্ঞান ছিল না। মাহে রমজান মাস শুরু হলেও তখন মানুষের মাঝে সিয়াম পালনে তেমন কোনও আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারতো না। 

তরুণ সমাজের কেউ তখন রোজা পালন করতো না। শুধুমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিরা রোজা রাখতোতাও আবার সবাই না। বয়স্ক ব্যক্তিদের মাঝেও অনেকে রোজা রাখতো না। অল্প কয়েক জন যারা রোজা রাখতো তারা দিনের বেলা পানি ও তামাক পান করতো। তারা রোজা থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র ভাত খাওয়া হতে বিরত থাকতো পানি ও তামাক খাওয়াতে যে রোজা নষ্ট হয় এবিষয়ে তাদের জ্ঞান ছিল না। তারা তাদের আশে পাশে হিন্দুদের রীতি-নীতি দেখায় অভ্যস্ত হওয়ায় তারা রোজাটাকে হিন্দুদের উপবাসের মতো মনে করতো। পানি ও তামাক পান করার সময় তারা রোজাটাকে একটা চোঙ্গার মধ্যে ভরে রাখতোরোজা চোঙ্গার মধ্যে ভরে রাখার নিয়মটা ছিল এমন যে, একদিকে গিরোওয়ালা মোটা বরাক বাঁশ দিয়ে তারা চোঙ্গা তৈরি করতো। 

এই চোঙ্গা দুই একটা সব মানুষের বাড়িতে থাকতো। এই চোঙ্গাতে সারা বছর পুরুষরা তামাক রাখতোআর বাড়ির মেয়েরা রাখতো লবণ, সুচ, গরম মসলা, লাউ-কুমড়ার বীচি ইত্যাদিরোজার মাসে মাঠে যাবার সময় এই রকম এক একটা চোঙ্গা রোজাদাররা সঙ্গে করে নিয়ে যেতপানি ও তামাক পানের সময় হলে তারা এই চোঙ্গার খোলা মুখে মুখ লাগিয়ে খুব জোরে দম ছাড়তোচোঙ্গা থেকে মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের টিপলা দিয়ে চোঙ্গার মুখ শক্ত করে বন্ধ করে দিত। 

যাতে ওর ভিতর থেকে বাতাস বাইরে বের হতে না পারে। তারপর তারা তাদের ইচ্ছা মতো পানি ও তামাক পান করতো। পান করা শেষ হলে তারা আবার চোঙ্গার মুখ খুব দ্রুত খুলে তার মুখে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে চোষ দিয়ে ভিতরের বাতাসগুলো আবার পেটের ভিতর নিয়ে নিত। এরূপ করার মাধ্যমে তারা বুঝতো তারা পানি ও তামাক পান করার আগে তাদের রোজাকে চোঙ্গার মধ্যে ভরে রেখেছিল এবং পান করা শেষে আবার রোজা তার মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। খুব ধার্মিক মানুষরা বা যারা একটু জানে বোঝে তারা এরূপ করাটা পছন্দ করতেন নাকিন্তু সাধারণভাবে এটাই চালু ছিল

অনেকে আবার দিন-রাত একাধারে রোজা রাখতো। এরূপ রোজা কষ্ট দায়ক হওয়ার কারণে অনেকে দুই-তিনটির বেশী রোজা পালন করতে পারতো নাফলে তারা রোজার মাসে এক রোজাপেট পুরে ভাত খেত আবার দুই-তিনটি রোজা এক সাথে রোজা রাখতো। এভাবে রোজা কেবল বৃদ্ধরাই পালন করতো, যুবক বা শিশুরা পালন করতো না। কষ্টের কারণে রোজার মাঝে তারা যে কয়টি রোজা ভেঙ্গে ফেলাতো সেই রোজাগুলো তারা ঈদের পরে একটির বদলে দুইটি রে পালন করতোআবার এমন নিয়মও অনেকের মধ্যে ছিল যে, ছোট এবং বড়রা রোজা রেখে দিনের বেলা প্রয়োজনে খাবার খেত কিন্তু রাতের বেলায় কোন খাদ্য গ্রহণ করত না। 

তাদের এরূপ বিশ্বাস ছিল যে, এমন খাবার গ্রহণে রোজা নষ্ট হয় নাসিয়াম পালনের এরকম অনেক বিচ্ছিন্ন নিয়ম চালু ছিল ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় ভারতীয় উপমহাদেশে। অবশ্য পরে ধীরে ধীরে ইসলামের প্রচার-প্রসার বৃদ্ধি, মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার, সচেতনতা মূলক কর্মকাণ্ড ও মুসলমানদের ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির ফলে রোজার প্রকৃত নিয়ম, বিধি-বিধান ও গুরুত্ব সম্পর্কে মুসলমানরা জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.