Header Ads

মানব দেহ সংরক্ষণ পদ্ধতি !

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আর মানুষের এই দেহ অপার রহস্যের আধার। দেহ যন্ত্রটি সৃষ্টিকর্তা তার আপন মহিমায় এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তার কোনও ত্রুটি নেই। মানুষের শরীরের আকৃতি এতই সুন্দর যে মানুষ তা বহু বছর ধরে সংরক্ষণের চেষ্টা করে এসেছে। তাদের চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছে সেটা নয়। পূর্বে মানুষের মৃতদেহকে মমি করে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। মিশরের পিরামিড গুলো আজও তার প্রমাণ বহন করে আসছে। এরপর মানুষ দেহকে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন নিয়ম ও রাসায়নিক পদার্থের সাহায্য নিয়ে এসেছে।

বছর-বছর ধরে এই সকল প্রচেষ্টার ফলে বর্তমানে মানব শরীর সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির সূত্রপাত হয়েছে। নতুন এই পদ্ধতিতে মানুষের দেহকে সফলভাবে সংরক্ষণ করা হয়। তবে এর জন্য বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।

মানবদেহ সংরক্ষণ করে রাখার আধুনিক পদ্ধতির নাম প্লাস্টিনেশনএই পদ্ধতিটির জনক জার্মান বিজ্ঞানী গুন্টার ভন হাগেন্সমানব শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য শত শত বছর ধরে মানুষ নানাভাবে চেষ্টা করে এসেছেসেই প্রাচীন মিসরের মমি থেকে শুরু করে আধুনিক জগতের প্লাস্টিনেশনশুরুতে দেহ সংরক্ষণের লক্ষ্যটা ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে দেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যও পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে শরীর সংরক্ষণ করা হয় মানব দেহ সম্পর্কে জানতে। মানব শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপার রহস্যকে খুঁজে বের করা দেহ সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য।

১৯৭৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী গুন্টার ফন হাগেন্স মানব দেহ সংরক্ষণের এই প্লাস্টিনেশন পদ্ধতি আবিষ্কার করেনপ্লাস্টিনেশন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'প্লাসিন'  থেকে। যার অর্থ আকৃতিতে রূপ দেওয়াপ্লাস্টিনেশনের মাধ্যমে কেবল জৈবিক শরীরের অঙ্গ ও কোষ নয়, গোটা শরীরকেও সংরক্ষণ করা যায়মানুষ মারা যাওয়ার পর থেকেই তার শরীর দ্রুত পচতে শুরু করে যাকে বলা হয় 'ডিকম্পোজিশন' প্রথমে শরীরে থাকা এনজাইম কোষগুলো অবমুক্ত হতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে গোটা শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং মাইক্রো অর্গানিজমগুলো পচতে শুরু করে 

প্লাস্টিনেশন পদ্ধতিতে শরীরের এই পচন ক্রিয়াকে রোধ করার জন্য প্রথমে শরীরে থাকা পানি এবং চর্বি সরিয়ে তার জায়গায় পলিমার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়প্লাস্টিনেশন শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলোকে টিকে থাকতে দেয় না, ফলে শরীরও আর পচতে পারে নাতবে শরীরের তরল পদার্থগুলো সরাসরি পলিমারের সংস্পর্শে কাজ করতে পারে নাতাই গুন্টার ফন হাগেন্স একটি বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেনপ্রথমে শরীরের মধ্যে এসেটোন নামে এক ধরনের দ্রাবক ঢুকানো হয়এরপর তার জায়গায় পলিমার ব্যবহার করা হয়প্লাস্টিনেশনের মাধ্যমে শরীরকে দুইভাবে সংরক্ষণ করা হয়একটা হলো কাগজের মতো পাতলা করে মৃত শরীরটিকে কেটে রাখাঅথবা পুরো আস্ত শরীরটাকেই বিভিন্ন ভঙ্গিতে রেখে দেওয়া

আসুন আমরা প্লাস্টিনেশন পদ্ধতির ধাপগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। প্লাস্টিনেশন করার জন্য প্রথম পর্যায়ে মৃতদেহটির ভেতরে ফরমালিন ঢোকানো হয়ধমনির মাধ্যমে এই ফরমালিন গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই ফরমালিন ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলেফলে শরীরের কোষগুলোর 'ডিকম্পোজিশন' বা দ্রুত পচন প্রক্রিয়া থেমে যায়এরপর গোটা শরীরটাকে এসেটোন নামক একটি দ্রাবকের চেম্বারে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চুবিয়ে রাখা হয়তবে তার আগে দেহ থেকে পানি এবং অতিরিক্ত চর্বি সরিয়ে ফেলা হয়। 

জেনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেহকোষের শতকরা ৭০ ভাগই গঠিত পানি দ্বারাপরবর্তী পর্যায়ে এসেটোনের জায়গায় পলিমার সলিউশন ব্যবহার করা হয়এজন্য মৃতদেহটিকে একটি ভ্যাকুয়াম চেম্বারের মধ্যে রাখা হয় এবং তার ভেতরে বাতাসের চাপ আস্তে আস্তে কমানো হয়এক পর্যায়ে চেম্বারে থাকা এসেটোন ফুটতে শুরু করেএভাবে কোষে জমে থাকা এসেটোনগুলো বের হয়ে যেতে শুরু করেচেম্বারের অন্য একটি পাইপ দিয়ে ঢোকানো হয় পলিমারযেমন এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সিলিকন রাবারএই সিলিকন রাবার কোষগুলোর ভেতরে প্রবিষ্ট হয় এবং দেহের সব কোষে এই পলিমার বা সিলিকন রাবার পুরোপুরি প্রবিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। 

এভাবে কয়েক সপ্তাহ পার হয়সিলিকন রাবারের কারণে গোটা চেম্বারই একটি শক্ত টুকরোয় পরিণত হয় যার ভেতরে শুয়ে থাকে মৃত মানুষের শরীর তারপর সেই জমাট বাঁধা শক্ত টুকরোটি বিশেষভাবে কাটা হয়অত্যন্ত পাতলা মাত্র কয়েক মিলিমিটার চওড়া করে কাটা এসব ফালিতে একটি মানুষের শরীরের প্রতিটি অংশ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেএকে বলা হয় শিট প্লাস্টিনেশনতবে মৃতদেহটিকে পলিমারের মধ্যে জমতে না দিয়ে বের করেও আনা যায়এ ক্ষেত্রে দেহটিকে যে কোনও ভঙ্গিতে বসানো কিংবা দাঁড় করানো যায়তবে এ জন্য বিশেষ পলিমার ব্যবহার করতে হয় যেটা আলো, বাতাস এবং তাপের মধ্যে টিকে থাকতে পারে। 

এরপর পুরো দেহটিকে একটি এয়ার টাইট চেম্বারে রাখা হয় এবং তাতে গ্যাস এবং তাপ ঢোকানো হয়এর ফলে দেহটিকে যেই ভঙ্গিতে বসানো হয়েছে সেভাবেই সেটি শক্ত হয়ে যায় এবং এভাবেই টিকে থাকে মাসের পর মাস বছরের পর বছরএই পদ্ধতিকে বলা হয় ফিগার প্লাস্টিনেশন একটি মৃত দেহের প্লাস্টিনেশনের এই প্রক্রিয়া শেষ করতে সাধারণত এক বছরের মতো সময় লেগে যায়

প্লাস্টিনেশন সফল হলে একটি দেহকে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায়। বর্তমানে মানব দেহকে সংরক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিনেশন পদ্ধতিকে বেছে নেয়া হয়। মেডিকেল কলেজগুলোতে ছাত্রদের মানব শরীর সম্পর্কে পড়ানোর জন্য প্লাস্টিনেশন কৃত মানব দেহ ব্যবহার করা হয়। 

বিশ্বের বড় বড় মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শত শত প্লাস্টিনেশন কৃত মানব দেহ সংরক্ষিত আছে। প্লাস্টিনেশন পদ্ধতি আবিষ্কার হলেও মানব দেহ সংরক্ষণের জন্য গবেষণা বন্ধ হয়নি। ভবিষ্যতে হয়তো আরও নতুন কোনও পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যাবে, যেটি হবে আরও সহজ ও দীর্ঘস্থায়ী।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.