Header Ads

বিশ্বজুড়ে বাঁম-হাতিদের যত কারিশমা

হাত মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষ পার্থিব যেসব কাজ করে তার অধিকাংশই হাত নির্ভর। মানুষ দুই হাত বিশিষ্ট। যার একটি ডান এবং অপরটি বাম। স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে ডান হাত বিশিষ্ট মানুষের সংখ্যা বেশী। ডান হাত বিশিষ্ট বলতে যারা ডান হাত দ্বারা স্বাভাবিক কাজ কর্ম করে থাকে তাদের বুঝাই। মানুষের শারীরিক অসম্পূর্ণতা বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে যে কোনও ধরনের পৃথক বৈশিষ্ট্যের নির্দিষ্ট কিছু পার্থক্য আছে। পৃথক এসব বৈশিষ্ট্য একজন মানুষকে অন্যসব মানুষ থেকে কিছুটা আলাদা করে রাখেযেমন বলা যায় বাঁ-হাতিদের কথা। 

মানুষ স্বাভাবিকভাবে যাবতীয় কাজ ডান হাত দ্বারা করে থাকে। তবে আমাদের আশপাশে এমন কিছু মানুষ আছে যারা কাজ করার জন্য বাম হাত বেশি ব্যবহার করেনআমরা তাদের বলি বাঁ-হাতি এদেরকে আবার ন্যাটাও বলা হয়ে থাকে।

পৃথিবীতে বাঁ-হাতি মানুষের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ মানুষ বাঁ-হাতি। বাম-হাতি মানুষেরা কিন্তু প্রতিবন্ধী নয়। এরাও স্বাভাবিক মানুষ ডান-হাতিদের মতোই। বাঁ-হাতিরাও পারিবারিক ভাবে অন্য সদস্যের মতো সুস্থ ও সুন্দর জীবন-যাপন করেমানুষের মাঝে কেউ কেউ কেন বাঁ-হাতি হয়ে থাকে এ ব্যাপারে গবেষকদের রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। গবেষকরা বাঁ-হাতি হওয়ার জন্য মানুষের শরীরের এক ধরনের জিনকে দায়ী করেছেন। 

আর এ জিনের প্রভাবে যে কোনও পরিবারেই এক বা একাধিক শিশু বাঁ-হাতি বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মাতে পারেচিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে মানুষের মস্তিষ্কের ডানদিক তার বাম হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার একইভাবে মস্তিষ্কের বামদিক তার ডান হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং মস্তিষ্কের যে পাশের জিন বেশী ক্রিয়াশীল থাকে তার অপর পাশের হাত বেশী ক্রিয়াশীল থাকে।

সাধারণভাবে ডান হাতের উপর ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কের বাম অর্ধাংশ কথা, ভাষা, লেখা, যৌক্তিক কার্যাবলী এবং গণিত ও বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে, যাকে বলা হয় লিনিয়ার থিংকিং মোডঅন্যদিকে বাম হাতকে চালনাকারী মস্তিষ্কের ডান অর্ধাংশ সংগীত, শিল্পকলা, উদ্ভাবনী শক্তি, উপলব্ধি ক্ষমতা, আবেগ আর বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ করে, যাকে হলিস্টিক থিংকিং মোড বলেডান পাশের মস্তিষ্কের প্রভাবের কারণে সাধারণভাবে ডান হাতিদের চেয়ে বাঁ-হাতিরা একটু বেশি সৃজনশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আর কিছুটা চিন্তাশীল স্বভাবের হয়ে থাকেবাম-হাতিরা সংখ্যায় ডান-হাতিদের চেয়ে কম হলেও তাদের কৃতিত্বের পরিসংখ্যান দেখলে ডান-হাতিরা ঈর্ষান্বিত হতে পারেন।

বারাক ওবামা
বাঁ-হাতিরা অধিকাংশই সাধারণ কর্ম ও পেশার চেয়ে সংগীত, শিল্পকর্ম, গণমাধ্যমের ও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়এছাড়া সাধারণভাবে তাদের ত্রিমাত্রিক বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাধারা ও উপলব্ধির ক্ষমতা বেশিএজন্য বাঁ-হাতিরা ডান-হাতিদের চেয়ে ভাল চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং স্থাপত্যবিদ হয়ে থাকে। অধিকাংশ খেলায় হাত ও চোখের সমন্বয়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণতাই দেখা যায় বাঁ-হাতিরা খেলাধুলায়ও অগ্রগামীক্রীড়াজ্ঞনে তাকালে দেখা যাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সকল খেলোয়াড়রা ছিলেন বাম-হাতি। 

যেমন, ফুটবলের কয়েকজন বাম-হাতি খেলোয়াড় হলেন পেলে, ম্যারাডোনা, রোমারিও, হুগো স্যানচেজ। ক্রিকেটে আছেন এলান বোর্ডার, গ্যারি সোবার্স, ব্রাইন লারা, ওয়াসিম আকরাম, সনাৎ জয়সুরিয়া, সৌরভ গাঙ্গুলী, সাকিব আল হাসান। টেনিসে আছেন রাফায়েল নাদাল। লেখালেখির ক্ষেত্রেও কিন্তু পিছিয়ে নেই বাম-হাতিরা। বাঁ-হাতি কয়েক জন বিখ্যাত লেখক হচ্ছেন জেমস বাল্ডউইন, বেট বাউয়েন, পেটার বেনচিলি, এইচ জি ওয়েলস, সি ওয়ার্নার। 

সংগীতের জগতে আছে বাঁ-হাতিদের শক্ত পদচারনা। বিখ্যাত কয়েকজন মিউজিশিয়ান হচ্ছেন ডেভিড বার্নি, রবার্ট প্লান্ট, মেরি মেলিনসন, পল সিমন, ম্যালিসা ম্যানচেস্টার, আলবার্ট কিং, পল উইলিয়ামস, লেনি হোয়াইট, টেনি টেম, কোলি পর্টার, জর্জ মাইকেল। বাম-হাতি বিখ্যাত চিত্রকর গনের মধ্যে আছেন লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, রেপিহেল, নেইম্যান, পল কেলি। অভিনয় জগতে রয়েছে অসংখ্য বাঁহাতি তারকা। যাদের কয়েক জন হচ্ছেন জন উডয়ার্ড, জন এডামস, হ্যারি এন্ডারসন, অমিতাভ বচ্চন, রবার্ট ব্লাক, জর্জ বার্নস, চার্লি চ্যাপলিন, জর্জ গোবেল, টম ক্রুজ, ডেভিসন, ম্যাট ডিলন, এনজেলিনা জোলি, নিকোল কিডম্যান, শার্লি জোনস, রোডি ভ্যালি, জেমস ক্যামেরুন, রেক্স হ্যারিসন।

ম্যারাডোনা
রাজনীতি, সমাজনীতি বা রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়ার যোগ্যতাইও পিছিয়ে নেই বাঁ-হাতিরা। তাদের পরিসংখ্যান শুনলে আপনি হয়তো বলবেন এই বিভাগে তারাই এগিয়ে আছে। বর্তমান পর্যন্ত যে কয় জন ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে আট জনই ছিলেন বাঁ-হাতি। জেমস গারফেল্ড, হার্ভাট হোভার, হ্যারি ট্রুম্যান, জেরাল্ড ফোর্ড, রোনাল্ড রিগান, বিল ক্লিনটন, জর্জ ডব্লিউ বুশ সহ বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছিলেন বাম-হাতি। আমেরিকার রাজনীতিতে যারা অবদান রাখেন সেই সব রাজনীতিবিদদের মধ্যে ২০ জনই হচ্ছেন বাঁ-হাতি। 

এবার আসা যাক বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান শুনলে হয়তো আপনি ভাববেন পৃথিবীটাই হয়তো বাঁ-হাতিরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বজুড়ে যেসকল বিখ্যাত বাম-হাতি ব্যক্তি ছিলেন বা আছেন তাদের মধ্যে কয়েক জন হচ্ছেন, ফরাসি রাজকুমারী জোয়ান অব আর্ক, মিশরের দ্বিতীয় রামশীশ, রোমান সম্রাট তাবরুজ, আলেকজান্ডার দি গ্রেট, রোমান জেনারেল জুলিয়াস সিজার, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই, ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া, ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ জর্জ, ব্রিটেনের প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্স উইলিয়াম, কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্চামিন নেতানিয়াহু ও ইহুদ ওলমার্ট, টেনিস খেলার ডেভিস কাপের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিস, সার্জন মার্ক সিলভার, হেলেন কিলার, বালক স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড পাওয়েল, সাংবাদিক ব্যারি ও বর্ডার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগানের পুত্র রন রিগান, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, এরিস্টটল, মহাকাশচারী নীল আমস্টারডাম।

এনজেলিনা জোলি
দিন যত যাচ্ছে বাঁ-হাতিদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে ধারণা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে তাদের প্রয়োজনীয়তা আছে, এটাও মানুষ উপলব্ধি করছেবাঁ-হাতিরা যে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো ডান হাতিদের চেয়ে বেশী দখল করতে পারে সেটা প্রমাণিত। বাঁ-হাতিদের সম্মানার্থে প্রতি বছর ১৩ আগস্ট পালিত হয় আন্তর্জাতিক বাঁ-হাতি দিবসএ দিনটি উপলক্ষে বাঁ-হাতিদের দক্ষতা ও মননশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটা সুযোগ ঘটেপরিবারের সদস্য, বন্ধু, সহকর্মীসহ সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই দিনটি উদযাপনের মূল উদ্দেশ্যদিনটি উপলক্ষে বিখ্যাত বাঁ-হাতি ব্যক্তিত্বদের দক্ষতা ও মেধাকে প্রচারের লক্ষ্যে রেডিও ও টিভিতে সাক্ষাৎকার গ্রহণসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তাদের কৃতিত্বকে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হয়বাঁ-হাতিদের একটি সংগঠন ১৯৭৬ সালে প্রথম আমেরিকায় দিবসটি পালন শুরু করে

পূর্বে বাঁ-হাতিদের ব্যবহারের জন্য জিনিসপত্র আলাদা ছিল না, কিন্তু বর্তমান সময়ে বাঁ-হাতিদের ব্যবহারের জিনিসপত্র তাদের মতো করে তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাঁ-হাতিদের সফলতায় বাঁ-হাতিরা মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আপনি যদি বাম-হাতি হয়ে থাকেন আর আপনার মনে তার জন্যে যদি কোন ক্ষোভ থাকে তবে সেটি পরিত্যাগ করে এখন আপনিও নিজেকে বাঁ-হাতি হিসেবে গর্ব করতে পারেন।

1 টি মন্তব্য:

  1. আমি একজন বাঁ-হাতি। এতদিন নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা মনে হলেও আজ আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি। এমন একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.