Header Ads

প্রাচীন মৃৎ শিল্পের আদ্যোপান্ত ইতিহাস

বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়েই পরিচিত হয় সেই দেশ বা জাতি । একেকটি শিল্পের বিস্তারের পিছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি শিল্প হচ্ছে মৃৎ শিল্প। আর এই মৃৎ শিল্পের উন্নতির জন্য চীনের অবদান রয়েছে সবার উপরে। চীনে একটি বিখ্যাত শহর আছে যার নাম থাংশান, যে শহরটি মৃৎ শিল্পের শহর নামেই পরিচিত। ইতিহাস অনুযায়ী চীনের থাংশান শহরে মৃৎশিল্পের জন্ম হয়েছিলআর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়

চীনের অন্যতম প্রাচীন শহর পেইচিং থেকে ১৫০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই শহরটি। এটি হচ্ছে চীনের মৃৎশিল্পের জন্মস্থানসবাই একে উত্তর চীনের মৃৎশিল্পের শহর বলেও ডাকেএই শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক গুলোতে মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত মিং রাজবংশের ইয়ুং লে এর সময়কালেএ শহরের রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের ইতিহাসএখানে নানা ধরনের চীনা মাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প রয়েছেএখানকার বিভিন্ন রকম মাটির মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্য চীনামাটি, স্বাস্থ্যসম্মত চীনামাটি, শিল্পায়ন চীনামাটি, হাইটেক চীনামাটি, শিল্পকলা চীনামাটি ইত্যাদি অন্যতম। 

১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই থাংশান শহর এবং তার আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে ভূমিকম্পের আঘাত এতই প্রবল ছিল যে, তা জাপানের হিরোশিমা শহরে নিক্ষিপ্ত এটোম বোমার চেয়ে ৪০০ গুণেরও বেশি ভূমিকম্পে ১০ লক্ষাধিক লোকসংখ্যা অধ্যুষিত থাং শান শহর মুহূর্তের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যায়এতে ২ লক্ষ ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারায় এবং ১ লক্ষ ৬০ হাজার লোক গুরুতর আহত হয়।


থাংশান শহরের ক্লে পার্ক

এশিয়া মহাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাসে দেখা যায়, খ্রিস্টীয় ১৩ শতকে সং রাজবংশের সময় চীনে তৈরি হতো মাটির তৈরি তৈজসপত্র ও শো-পিসএগুলোকে বলা হতো  'সেলাডন'এশিয়ানদের মধ্যে চীনারাই সর্বপ্রথম সেলাডন প্রস্তুত করেছিল এগুলো প্রস্তুতির পর দেশজুড়ে তো বটেই আশপাশের বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক সাড়া পড়েফলে চীনারা এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় সেলাডন রপ্তানি শুরু করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই সেলাডনগুলো তুরস্কের শাসকসহ অন্যান্য শাসক এবং রাজাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেঅবশ্য এর পেছনে ছিল এর মৌলিক সৌন্দর্যগুণ। 

এছাড়াও এক ধরনের বিশ্বাস ছিল যে, যদি কোনও খাদ্য বা পানীয় বিষাক্ত হয়ে পড়ে তবে তা সেলাডনের রং পরিবর্তন করে নির্দেশনা প্রদান করে। জাপানে ১০ হাজার ৫০০ বছর আগে জেমনরা প্রথম মৃৎপাত্র তৈরি করেছিলজাপানি জেমন শব্দের অর্থ হলো দড়ি বা রজ্জুর বাজারএ থেকে ধারণা করা হয় এ সময় মাটির পাত্র বা মূর্তি তৈরি করতে লাঠির সঙ্গে পেঁচানো দড়ি ব্যবহার করা হতো১০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের হ্যান রাজবংশের শেষভাগ, ২২০ থেকে ২৮০ খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় রাজবংশ, ২২০ থেকে ৫৮৯ খ্রিস্টাব্দের ষষ্ঠ রাজবংশ এবং ৬১৮ থেকে ৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ট্যাং রাজবংশের সময়কার মৃৎশিল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। 

তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মৃৎশিল্পের নতুন আঙ্গিকে পথ দেখিয়েছিলেন উইলিয়াম স্টেইট মুরে, লুইস রাই এবং হ্যান্স কপারের মতো কিছু প্রতিভাবান মৃৎশিল্পীতারা এ কাজটি করেছিলেন শিল্প-বিপ্লবের যুগেযখন মৃৎশিল্পীরা নিজেদের তৈরি হস্তশিল্পের জন্য একটি জায়গা খুঁজছিলেনকাদামাটিকে দলিত-মথিত করে তাকে শৈল্পিক অবয়ব দান এবং আগুনে পুড়িয়ে শক্ত কাঠামোতে রূপদানের মাধ্যমে মৃৎশিল্পের এই যে বিস্তার এর পেছনে রয়েছে চীন, গ্রিক, রোমান, পারস্য, মায়ানসহ অসংখ্য সভ্যতার ইতিহাসএ ক্ষেত্রে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মৃৎশিল্পের সন্ধান পাওয়া যায় গ্রিসের স্ট্যারিনি দ্বীপেখননের মাধ্যমে পাওয়া এ সিরামিক পাত্রগুলো পিথই নামে পরিচিত। 

তবে মানব আদলের সবচেয়ে প্রাচীন সিরামিক ভাস্কর্য পাওয়া গেছে চেক প্রজাতন্ত্রেএসব মূর্তিকে ভেনাস নামে অভিহিত করা হতোজেলিনি ভেস্টোনাইসের ভেনাস মূর্তিটি ছিল একটি নগ্ন নারী শরীরের অতিক্ষুদ্র প্রতিমূর্তি, যা প্রায় ২৭ হাজার থেকে ৩১ হাজার বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়এই ভেনাস মূর্তিতে ব্যবহৃত কাদামাটির সঙ্গে মিশ্রিত থাকত হাড়ের গুঁড়া এবং এগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত কাঠামোতে রূপদান করা হতো

আমেরিকার মায়ান জনগোষ্ঠী মৃৎশিল্পের উন্নয়নে সবচেয়ে অনুজপ্রতীমএদের সিরামিক শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে দশম শতকের মধ্যেব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা লুবান্টনএখানে যে সমস্ত সিরামিক শিল্প পাওয়া গেছে তার অনেক নমুনাই লুবান্টনেরগুয়েতেমালা এবং হন্ডুরাসের মায়ান অঞ্চলেও খুঁজে পাওয়া যায় এসব শিল্প। 

লুবান্টনের বর্তমান মায়ান জনগণ এখনো সেই মূল নকশার মৃৎশিল্প তৈরি করেবর্তমানে সময়ে এসে মৃৎশিল্প পেয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এই শিল্পটি অচিরেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ভাবা হলেও এটি ধীরে ধীরে এটি আরোও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.