Header Ads

মহামূল্যবান ময়ূর সিংহাসনের রহস্য

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা । এই সরকার ব্যবস্থায় যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদায় অভিহিত করা হয়। একটা সময় ছিল যখন বিশ্বে কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে তখন ছিল রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের শাসন। এই শাসন চালু থাকার সময়ে যারা সাম্রাজ্য শাসন করতেন তাদেরকে রাজা-বাদশাহ বা সম্রাট বলা হতো।

রাজা, বাদশাহ বা সম্রাটেরা বিশাল বিশাল আলিশান অট্টালিকায় বসবাস করতো। এই গৃহের একটা বিশেষ ঘর থাকতো যে ঘরকে বলা হতো দরবার। এই দরবারে বসে রাজা তার শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। দরবার গৃহে রাজার বসার জন্য থাকতো বিশেষ এক ধরনের আসন। যে আসনটি থাকতো বৃহৎ, সুসজ্জিত ও অনন্য। আর এই আসনকে বলা হতো সিংহাসন। 

রাজা নিজে এই সিংহাসনে বসতেন ও তার পাশে রানীকে পাশে বসিয়ে রাজ কার্য পরিচালনা করতেন। বিশ্বের ইতিহাসে নানান ধরনের সিংহাসন দেখতে পাওয়া যায়। এই সকল আসনের মধ্যে বিখ্যাত একটি আসনের নাম ময়ূর সিংহাসন। বিশ্বের সকল সিংহাসনগুলোর মধ্যে ময়ূর সিংহাসন ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান। ময়ূর সিংহাসন নিয়ে বিশ্বে নানান ধরনের কথা প্রচলিত আছে। বিখ্যাত সেই ময়ূর সিংহাসন আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু।

ভারতে মোঘল বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর। আর এই মোল স্থাপত্যের এক অনুপম নিদর্শন ময়ূর সিংহাসন। মোঘল সম্রাট শাজাহানের সময়ে ১৭ শতকের দিকে এই সিংহাসনটি তৈরি করা হয়। দিল্লিতে সম্রাট শাজাহানের রাজপ্রাসা দেওয়ান-ই-আমে এটি অবস্থিত ছিল। মোঘল শাসক গন ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। যার উদাহরণ হিসেবে ময়ূর সিংহাসনের কথাও বলা যায়। সম্রাট শাহজাহানের বিখ্যাত এই সিংহাসনটিকে ময়ূর সিংহাসন বলা হতো কারণ এই সিংহাসনটির পেছনে দুটি ময়ূর আকৃতির নকশা তৈরি করা ছিল। যা দেখলে মনে হতো সিংহাসনটির পিছনে দুটি ময়ূর দাড়িয়ে আছে। পেখম ছড়ানো সেই ময়ূর নকশাটির গায়ে নীলকান্ত মণি, পান্না, চুনি, মুক্তা সহ নানান ধরনের পাথরের নিখুঁত কারুকার্য করা ছিল।

পারস্য ভাষায় ময়ূর সিংহাসনকে বলা হয় তখত-ই-তাউস। মোগল সাম্রাজ্যের সময়ও এটিকে এই নামেই ডাকা হতো। দুর্লভ রত্ন 'কোহিনূর' খচিত ছিল এ সিংহাসনটিতেসম্রাটের তৎকালীন রাজকবি কুদসির বিশ জোড়া চরণের একটি কবিতা পান্নার অক্ষরে সিংহাসনে খোদাই করা ছিল। দিল্লি সফরকালে ১৬৬৫ সালে ফরাসি জহুরি টেভার্নিয়ার ময়ূর সিংহাসন সম্পর্কে একটি বর্ণনা প্রদান করেন। তিনি বলেন, ময়ূর সিংহাসনের দৈর্ঘ্য ছিল ৬ ফুট ও প্রস্থ ছিল ৪ ফুট। সিংহাসনের পায়াগুলো ছিল সোনার তৈরি। যেগুলোর উচ্চতা ছিল ২০ থেকে ২৫ ইঞ্চি চারপাশ থেকে ১২টি থামের সাহায্যে চন্দ্রাকার শামিয়ানা দেয়া থাকতো এই আসনের উপরিভাগে। নিচের রেলিংগুলো পান্না, চুনি, হীরা এবং মুক্তার সমারোহে ছিল মনোহারী। 


সর্বমোট ১০৮টি বড় চুনি পাথর এবং ১১৬টি পান্না ব্যবহৃত হয়েছিল সিংহাসনটিতে। ১২টি থামে ব্যবহৃত মুক্তাগুলোই ছিল সর্বাপেক্ষা দামি। এগুলোর তৎকালীন মূল্য ছিল ১০০ মিলিয়ন রুপি। এই সিংহাসনটির মূল্য কি পরিমাণ হতে পারে সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক গবেষণা করেছেন। তাদের মতে এটির মূল্য বর্তমান সময়ে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা তার চেয়েও বেশী হতে পারে।

সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর ময়ূর সিংহাসন এক জায়গায় থাকেনি। ১৭৩৮ সালে নাদির শাহ মোগল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে পরাজিত করে দেশে ফেরার সময় অন্যান্য ধনরত্নের সঙ্গে ময়ূর সিংহাসনটিও নিয়ে যান। নাদির শাহ নিহত হওয়ার পর ৭৪৭ সালে ব্রিটিশরা এটি চুরি করে নৌপথে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়ার পথে তাদের জাহাজ ডুবি ঘটে। ফলে সাগর তলে হারিয়ে যায় মহা মূল্যবান ময়ূর সিংহাসন।

পরে আবার বিশ্বে প্রচার করা হয় ময়ূর সিংহাসনের কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং সেগুলো উসমানীয় শাসককে প্রদান করা হয়েছে। তবে সে তথ্যের কোনও সঠিক ভিত্তি ছিল না। তাই বলা যায় সম্রাট শাহজাহানের বিখ্যাত সৃষ্টি ময়ূর সিংহাসনের শেষ অবস্থান হয়েছে সাগর তলে।

২টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.