Header Ads

বাংলার ঐতিহ্য গুড় পুকুরের মেলা !

বাংলাদেশ বিশ্বের এক বিস্ময়। ষড়ঋতুর এদেশ তার রূপ, গুন ও সৌন্দর্যে সবার মাঝে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। রূপে-গুনে যেমন এই দেশ স্বপ্নের মতো ঠিক তেমনি এখানে বসবাসকারী মানুষগুলোও সহজ সরল ও শান্তি প্রিয়। আদি কাল থেকেই মানুষ এখানে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছে, ফলে এখানের মানুষগুলো অনেক বেশী বিনোদন প্রিয়।

বিনোদনের উৎস হিসেবে মেলা, নৌকা বাইচ, ঘোড়া দৌড় এগুলো ছিল তাদের প্রধান মাধ্যম। তবে বিনোদনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল মেলাকে ঘিরে। হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ সবাই ভিড় করতো মেলায়। ঐতিহ্যগতভাবে বছরের পর বছর পালিত হতো এই মেলাগুলো। ঠিক তেমনই একটি মেলা হচ্ছে গুড় পুকুরের মেলা। প্রায় ৩শ বছর ধরে চলে আসছে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী মেলাটি।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ জেলা সাতক্ষীরা। প্রতি বছর বাংলা ভাদ্র মাসের শেষ দিনে সাতক্ষীরা জেলা শহর জুড়ে এই মেলা বসে। গুড় পুকুর মেলা দেখতে বা জিনিস পত্র কিনতে বাংলাদেশের সকল জেলা, ভারতের কলিকাতা সহ বিভিন্ন দেশ থেকে সাতক্ষীরায় লোক সমাগম ঘটে থাকে। সাতক্ষীরা শহরের বাসিন্দাদের যেসকল আত্মীয় স্বজন গ্রামে বা সাতক্ষীরার বাইরে বসবাস করে তারা এই সময় শহরের নিজ নিজ আত্মীয়ের বাড়িতে আগমন করে থাকে এই মেলায় এমন কোনও কিছু পণ্য বাদ যায় না যা মেলায় পাওয়া যায় না। 

হাড়ি-পাতিল, দা-খুন্তা-কোদাল, গাছ-গাছালি, আসবাবপত্র, ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র, পোড়া মাটি ও চীনা মাটির তৈজসপত্র, অরনামেন্টস, দেশী-বিদেশী পোশাক-পরিচ্ছেদ, খেলনা, মাটি, লোহা, তামা, পিতল, স্টিল, কাচ, কাঠ, বাঁশ ও বেতের জিনিস, প্রসাধনী, ঘর সাজানোর দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে সব কিছুই পাওয়া যায় এই মেলায়।
এই মেলায় দোকানগুলো আসে সাতক্ষীরা সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে, বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ব্রাক্ষণবাড়িয়া প্রভৃতি। এক সময় এই মেলায় কলিকাতা ও লন্ডন থেকেও দোকান আসতো। মেলায় শুধু ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও থাকে দেশীয় বিনোদনের নানা ব্যবস্থা। নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রা, অপেরা, যাদু খেলা ইত্যাদিতে মোহিত থাকে মানুষ জন।

গুড় পুকুর মেলাটি মূলত হিন্দুদের উৎসব বা মেলা ছিল। বাংলা ১০৭০ সালের দিকে সর্বপ্রথম এই মেলার সূচনা হয়। তবে কালের পরিক্রমায় এটি সকল ধর্মের লোকদের কাছে পরিচিতি পেয়ে যায়। প্রতিবছর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ভাদ্র মাসের শেষদিনে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মনসা পূজা। এই পূজাকে কেন্দ্র করে গুড় পুকুরের পাশে এই মেলার সূচনা করা হয় তবে কে বা কারা মেলাটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার কোনও ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না।

তবে জনশ্রুতি রয়েছে বাংলা বার শতকের কোন এক সময় বুড়া খাঁর বংশধর ফাজেল খাঁন চৌধুরী শহরের পলাশপোল এলাকায় খাজনা আদায় করে ফিরছিলেনক্লান্তিতে এক পুকুর পাড়ে বটগাছের ছায়ায় বসা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েনবটপাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ছিল ফাজেলের মুখেগাছের মগডালে জড়িয়ে ছিলো এক পদ্ম গোখরা সাপ। 

সাপটি নেমে এসে ফনা তুলে ছায়া করে রেখেছিল ফাজেলের মুখেফাজেল খাঁনের ঘুম ভেঙ্গে গেলে বটগাছের পাতায় চোখ ফেরাতেই তিনি দেখতে পান সাপটিকেতখনও সাপটি ফনাতুলে সূর্যকে আঁড়াল করে আছেতারপর এক সময় ফনা নামিয়ে সাপটি হারিয়ে যায়ফাজেল খাঁন বটতলা ত্যাগ করার সময় স্থানীয় হিন্দুদের ডেকে ওই স্থানে মনসা পূজা করার আহ্বান জানান সে দিন ছিলো ভাদ্র মাসের শেষ দিনবাংলা বার শতকের গোড়ার দিকে কোন এক বছর পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের ওই বটতলায় শুরু হয় মনসা পূজা। 

এই পূজার মিষ্টি প্রসাদ পাশের পুকুরে ফেলার ফলে পুকুরের পানি মিষ্টি হয়ে যায়। ফলে গোলাকৃতি পুকুরের নাম হয়ে যায় গুড় পুকুর। সেই থেকে মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এবং পুকুরের নামানুসারে শুরু হয় গুড় পুকুরের মেলা।
আঠারো শতকের দিকে মেলার একটি অংকিত চিত্র
মেলার ইতিহাস একটি মাত্র হলেও পুকুরের নাম গুড় পুকুর নামকরণের অন্যান্য
আরও অভিমত রয়েছে, কারো মতে পুকুরে মনসা পূজার বাতাসা ফেলা হতো আর ঐ বাতাসার জন্য পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো বলেই এধরণের নামকরণ হয়েছে। কারো মতে, এটা এমন একটা পুকুর ছিল যাতে বেশী দিন পানি থাকতো না পরে কে বা কারা স্বপ্নে দেখেন পুকুরে ১০০ ভাঁড় গুড় ঢালতে হবে তাহলে পুকুর পানিতে ভরে উঠবে।


স্বপ্ন অনুযায়ী পুকুরে ১০০ ভাঁড় গুড় ঢালা হয় ফলে পুকুর পানিতে ভরে উঠে। আর সেখান থেকেই এই পুকুরের নাম হয় গুড় পুকুর। আবার কেউ বলেন, এক সময় এই পুকুরের তলদেশ থেকে মিষ্টি পানি উঠতো, আর সে জন্যেই এই পুকুরের নাম এমনটি হয়েছে। অন্য বর্ণনা মতে পুকুরের পাড়ে একসময় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। একবার সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড় তৈরি করে তার বিক্রীত মূল্যে খনন করা হয় এই পুকুর। আর সেই থেকেই এই পুকুরের নাম গুড় পুকুর। তবে ঐতিহাসিক আবদুস সোবহান খান চৌধুরীর মতে, সাতক্ষীরার চৌধুরী পাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌরবর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর। সেই 'গৌরদের পুকুর' কথাটি এক সময় বিবর্তন হয়ে দাড়ায় 'গুড় পুকুর'
সাতক্ষীরার গুড় পুকুর মেলা প্রতি বছর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়। মেলাটি পূর্বে জাকজমকপূর্ণভাবে এক মাস ব্যাপী উদযাপন করা হতো। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলা চলাকালে শহরের রকসি সিনেমা হল স্টেডিয়ামে সার্কাসের প্যান্ডেলে সন্ত্রাসীরা এক যোগে বোমা হামলা চালায়। এই ঘটনায় ৩ জন নিহত শতাধিক আহত হয়। এই ঘটনার পরে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মেলাটি বন্ধ ছিল। ২০০৯ সালে আবার শুরু হয় এই মেলা। এখন মেলাটি স্বল্প পরিসরে ৩০ দিন ব্যাপী পালিত হয়।

মেলাটি তার জৌলুস হারিয়ে ফেললেও এখনও তা গর্বের সাথে প্রতি বছর পালিত হয়। ৩০০ বছরের পুরাতন গুড় পুকুরের মেলা সাতক্ষীরা তথা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্য।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.