Header Ads

প্রকৃতির অজানা শত্রু পার্থেনিয়াম !

প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে মানুষ বসবাস করে থাকে। আর এই প্রকৃতির অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে উদ্ভিদ। মানুষের বসবাসের কেন্দ্রের চারদিক ঘিরে থাকে নানান উদ্ভিদ, গাছ, লতা ও পাতা। আর এই গাছ, লতা ও পাতার মধ্যে কিছু উদ্ভিদ, লতা, পাতা রয়েছে যা প্রাণী জগতকে উপকার করে। আবার এমন কিছু লতা, পাতা ও উদ্ভিদ রয়েছে যা প্রাণী জগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

কোন উদ্ভিদ গুলো আমাদের জন্য উপকারী এবং কোনগুলো ক্ষতিকর এই বিষয়ে আমরা প্রায় ধারনা রাখি না, ফলে এই সকল উদ্ভিদের নিকটে যাওয়ার ফলে মানুষ ও প্রাণীকুলের মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। আমাদের চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমনই একজাতীয় ক্ষতিকর উদ্ভিদ সম্পর্কে আজ আলোচনা করবো। যার নাম পার্থেনিয়াম। প্রকৃত অর্থে পার্থেনিয়াম এক ধরনের বিষাক্ত আগাছা। যা পরিবেশে থেকে মানুষ ও প্রাণীদের নানান ক্ষতি করে থাকে।

পার্থেনিয়ামের ইংরেজি রূপ PERTHENIUM এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Parthenium Hysterophorus. বাড়ির আশে-পাশে, রাস্তার ধারে, বন-জঙ্গলে বা ফসলের ক্ষেতে পার্থেনিয়াম জন্ম ও বিস্তার লাভ করে থাকে। এই বিষাক্ত উদ্ভিদটি সাধারণত উচ্চতায় ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। পার্থেনিয়াম দেখতে সাধারণত হাইব্রিড ধান গাছের মতো । শাখা বিস্তারের মাধ্যমে এর আকৃতি গম্বুজ আকৃতির অথবা ঝোপ আকারের হয়ে থাকে। পার্থেনিয়ামের পাতা সাধারণত গাজরের পাতার ন্যায় শাখা যুক্ত ত্রিভুজের মতো তারকা আকৃতির বিন্যাস্ত থাকে। এই উদ্ভিদে নিদিষ্ট বয়সে ফুল ফোটে। সাধারণত ফুলকপির মত লাকার, সাদা, আঠালো এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে এর ফুল

পার্থেনিয়ামের মূল উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো। মেক্সিকোতেই সর্বপ্রথম এই উদ্ভিদের জন্ম হয়। সেখান থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে একে একে আমেরিকা, আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশে সহ বিভিন্ন দেশে। পার্থেনিয়ামের একটি গাছ ৪ হাজার থেকে ২৫ হাজার অতিক্ষুদ্র বীজের জন্ম দিতে পারে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দেয় গাছটি। এই বীজ এতো ক্ষুদ্র যে সাধারণত গবাদিপশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতা-স্যান্ডেলের তলার কাদামাটি, সেচের পানি ও বাতাসের সঙ্গে এর বিস্তার ঘটে থাকে।

পার্থেনিয়াম একজাতীয় ছোট উদ্ভিদ হলেও প্রাণী জগত ও মানব জীবনে পার্থেনিয়ামের রয়েছে নানান ক্ষতিকর প্রভাব। এই আগাছায় Sesquiterpene Lactones নামক টক্সিন বা বিষ থাকে। যা গঠিত হয় Caffeic acid, Vanillic acid, Ansic acid, P-anisic acid, Chlorogenic acid, এবং Parahydroxy benzoic acid দ্বারা। এই বিষ মানুষ সহ অন্যান্য জীবের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়াও এই আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা অন্যান্য ফসলের বৃদ্ধি হ্রাস করে।

কিছুদিন আগেও পার্থেনিয়ামের প্রকোপ সামান্য ধারনা করা হলেও বর্তমানে এর কু-প্রভাব আবিষ্কার করা হয়েছে ব্যাপক হারে। পার্থেনিয়াম উদ্ভিদের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। ক্ষেতের ফসল বা উদ্ভিদের নিকটে পার্থেনিয়াম থাকলে সেই ফসলের ফলন মারাত্মক হারে কমে যায়। এছাড়া কীট-পতঙ্গের পরা-গায়নের দ্বারা পার্থেনিয়ামের পরাগ রেণু অন্য উদ্ভিদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে কীট-পতঙ্গ ও ফসল উভয়ের ক্ষতি করে থাকে। পার্থেনিয়াম উদ্ভিদের শোষণ কৃত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণে বাধা প্রদান করে এবং সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বাধা প্রদান করে থাকে। পার্থেনিয়াম আগাছা ফসলি জমিতে থাকলে ফসলের উৎপাদন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে ভুট্টার ক্ষেত্রে এ আগাছা ফল ধরার পর প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণ ক্ষমতা ত্রিশ শতাংশ হ্রাস করে। 

এছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন, এবং মরিচের ক্ষেত্রে এ আগাছা বীজের অঙ্কুরোদগম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। পার্থেনিয়াম গাছের সমস্ত অংশটাই ক্ষতিকারক। গোঁড়া থেকে আগা এর পরাগ, ডালপালা সবই মারাত্মক ক্ষতিকর।

উদ্ভিদ জগতের পাশাপাশি পার্থেনিয়াম প্রাণী জগতেও মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। পার্থেনিয়াম আগাছা যুক্ত মাঠে গবাদিপশু চরানো হলে পশুর শরীর ফুলে যায়, তীব্র জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় এবং পশুর বদ হজম দেখা দেয়। পার্থেনিয়াম গাছ ভক্ষণ করলে গবাদি পশু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এই ভাইরাস আক্রান্ত পশু জবাই করে এর মাংস ভক্ষণ করলে মানুষের শরীরও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। যার ফলে মানব শরীরে দেখা দেয় এজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে ক্যানসার সহ বিভিন্ন রোগ। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যক্তির যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়।

পার্থেনিয়াম আগাছা হাত দ্বারা স্পর্শ করলে বা চটকালে ছোট থেকে পরবর্তীতে বড় ধরনের রোগ দেখা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় হাত-পা চুলকায়, লাল হয়ে যায় এবং বৃহৎ আকারে ত্বকে ক্যানসারের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘন ঘন জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং অসহ্য মাথা ব্যথা ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগে।

যত দিন যাচ্ছে পার্থেনিয়ামের ভয়াবহ ক্ষতিকারক দিক আবিষ্কার হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে এই আগাছার পাশ দিয়ে হাটাও ক্ষতিকর। সবচেয়ে আতঙ্কের খবর হলো, ভারতের পুনেতে পার্থেনিয়ামজনিত বিষক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদগন বলেন সবার উচিত পার্থেনিয়াম সম্পর্কে পরিচিত হওয়া। যেখানেই পার্থেনিয়াম দেখতে পাওয়া যায় সেখান থেকেই এই আগাছা পরিষ্কার করা উচিত। পার্থেনিয়াম আগাছা তোলার সময় গাছটির সরাসরি স্পর্শ এড়ানোর জন্য অবশ্যই হাতে প্লাস্টিক অথবা পলিথিন গ্লাভস পরতে হবে। পার্থেনিয়াম আগাছা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে সেজন্য এর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং এটি নিয়ন্ত্রণে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। 

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা পার্থেনিয়ামের কিছু উপকারিতাও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। পার্থেনিয়াম আগাছাটি একটি ঔষধি উদ্ভিদও। বর্তমানে এই আগাছা থেকে মানুষের আমাশয়, প্রচণ্ড জ্বর, বদহজম, টিউমার, ক্যানসার সহ নানা ধরনের জটিল রোগের প্রতিষেধক তৈরি করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা পার্থেনিয়াম নিয়ে তাদের গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এবিষয়ে আরও নতুন কিছু জানা যাবে।

৬টি মন্তব্য:

  1. পার্থেনিয়াম সম্পর্কে শুধু নিজেরা সচেতন হলে চলবে না। অবশ্যই সবার আগে সচেতন করতে হবে আমাদের কৃষক সমাজকে। যারা মাঠে-ঘাটে কাজ করে এবং ফষল ফলাই তাদের সচেতনতা আগে দরকার। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, কৃষিই আমাদের দেশের প্রধান পেশা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. তালহা জুবাইর আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের দেশের কৃষক সমাজকে এই বিষয়ে সবার আগে সচেতন করা উচিত। কারণ এই ক্ষতির ভুক্তভোগি।

      মুছুন
  2. লেখকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এই কারণে যে, তিনি পার্থেনিয়ামের কিছু উপকারের কথাও বর্ণনা করেছেন। আসলে পার্থেনিয়ামের যেমন নেতিবাচক দিক রয়েছে ঠিক তেমনি এর রয়েছে কিছু ইতিবাচক দিক। আমাদের দেশের পরিবেশবিদগন শুধুমাত্র এর নেতিবাচক দিকগুলো দেখতে পান কিন্তু ইতিবাচকগুলো দেখতে পান না। ব্যপারটা দুঃখ জনক।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. নীল আকাশ আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

      মুছুন
  3. ভাই আমি কয়েকদিন ধরে ঢাকা ও রাজশাহীতে আছি। বাড়ি ফিরে নতুন লেখা আপলোড করবো। ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.