Header Ads

গৌরবময় নিদর্শন নাটোর রাজবাড়ী

ইতিহাস সভ্যতার কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে সামনে যাওয়ার পথ দেখায়, যে পথ ধরে মানুষ এগিয়ে চলে আরও উন্নতির পথে। প্রত্যেক দেশ ও সমাজের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। প্রত্যেক সমাজ ও জাতির ইতিহাস চিহ্নিত করা যায় সেখানের স্থাপত্য নিদর্শন দ্বারা। সেজন্য প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব স্থাপত্য নিদর্শনগুলো যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশেরও রয়েছে তেমনি কিছু মূল্যবান ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যিক নিদর্শন।

আর বাংলাদেশের এই নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে নাটোর রাজবাড়ী। অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী খ্যাত নাটোর অতীত গৌরব ধরে দাড়িয়ে আছে আজও। সেই সাথে অমর হয়ে রয়েছে নাটোর রাজবাড়ীর রাজাদের অনন্য কৃতিত্ব। রাজা-রানী আর প্রজাদের ঘিরে সেই সময়ের ইতিহাস আজও উকি মারে ইতিহাস প্রেমী মানুষকে। সপ্তদশ শতকে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক অনবদ্য ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে নাটোর রাজবংশের উৎপত্তি হয়। 

১৭০৬ সালে পরগণা বানগাছির জমিদার গণেশ রায় ও ভবানী চরণ চৌধুরী রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে চাকরীচ্যুত হন। দেওয়ান রঘুনন্দন জমিদারি তার ভাই রাম জীবনের নামে বন্দোবস্ত নেন। এভাবে নাটোর রাজবংশের পত্তন হয়। নবাবের নিকট থেকে ১৭০৬ বা ১৭১০ সালে জমিদারি লাভের পর রাজা রামজীবন নাটোর শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে বঙ্গজল নামক এলাকায় ৫১ একর জমির উপর বিশাল এ রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। রাজবাড়ী নির্মাণের স্থানটি এক সময় ছাইভাঙ্গার বিল নামে পরিচিত ছিল। 

রামজীবনের জমিদারীর রাজধানী নাটোরে স্থাপনকে কেন্দ্র করে অনেক বিচিত্র জনশ্রুতি আছে। যেমন বলা হয়, মায়ের আদেশে রাজা রামজীবন ও রঘুনন্দন নিজ জন্মভূমিতে রাজধানী স্থাপনের জন্য উপযুক্ত একটি স্থানের সন্ধান করছিলেন। এক বর্ষাকালে রঘুনন্দন রাজা রামজীবন ও পণ্ডিতবর্গ রাজধানী স্থাপনের জন্য উপযুক্ত একটি স্থান নির্বাচনে বের হয়েছিলেন। ঘুরে ঘুরে তারা ভাতঝাড়া বিলের মধ্যে উপস্থিত হন। বিলের একটি স্থানে তারা দেখতে পান যে, দুটি সাপ সাঁতার কেটে বিল পার হচ্ছে এবং একটি বড় ব্যাঙ ছোট একটি সাপকে গিলে খাচ্ছে। 

পণ্ডিতবর্গ উক্ত স্থানকেই রাজধানী নির্মাণের স্থান হিসাবে উপযুক্ত বলে মত প্রকাশ করায় তারা সেখানেই রাজবাড়ি নির্মাণ করবেন বলে স্থির করেন। রাজবাড়ি নির্মাণ করার পর রাজ-আমলা, কর্মচারী বহুবিধ লোকের সমাগমে অল্পদিনের মধ্যে বিলটি একটি শহরে পরিণত হয়। সেই পরিণত শহরই নাটোর।
তৎকালীন সময়ে ১৩৯টি পরগনা নিয়ে গঠিত ছিল নাটোর রাজ্য। রাজ্যের এই রাজবাড়ীটিই ছিল প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়। পরবর্তীতে রাজ্যের আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার বর্গমাইল। এই রাজ্যের বার্ষিক মুনাফা ছিল প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। রাজা রামজীবনের প্রধান দেওয়ান ছিলেন দয়ারাম রায়। ১৭১০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজা নাটোর রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু তাদের শাসন তেমন ভাবে ইতিহাসে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। 

১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পরে নবাব আলীবর্দি খাঁ রাণী ভবানীর উপর জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। রামজীবনের দত্তক পুত্র রাজা রামকান্তের স্ত্রী রানী ভবানী বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে এ রাজবংশকে ইতিহাসে স্থান করে নেন। ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত নাটোর রাজ্য ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে বৃহত্তম জমিদারি। রাণী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারি বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ওই সময় রানী ভবানীর রাজ্য ভ্রমণ করতে প্রায় ৩৫ দিন সময় লাগত। আর তখন বার্ষিক রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। মহারানী রানী ভবানীর দত্তক পুত্র রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিশাল এ জমিদারি তার দুই পুত্র বিশ্বনাথ ও শিবনাথ রায়ের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে বড় তরফ ও ছোট তরফ নামে দুটি আলাদা জমিদারির উত্থান ঘটে।

অপরূপ কারুকার্যখচিত বিশাল এই রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। রাজবাড়ির চত্বরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি ভবন রয়েছে। বাইরের শত্রুর হামলা থেকে রক্ষাকল্পে রাজবাড়ীর চতুর্দিকে রয়েছে চৌকি বা পরিখা। একতলাবিশিষ্ট মূল রাজপ্রাসাদে কক্ষ রয়েছে ১৫টি। এছাড়া এখানে ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর আছে। রাজবাড়ি বেষ্টন করে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। পুরো এলাকা বিভক্ত করা রয়েছে ২টি অংশে। যথা, ছোট তরফ ও বড় তরফ। রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলো হল শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির। 

১৯৮৬ সাল থেকে রাজবাড়ির পুরো এলাকাটি রানী ভবানী কেন্দ্রীয় উদ্যান বা যুব পার্ক হিসেবে নাটোর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই রাজভবনে রাজা রামজীবন, রামকান্ত ও অর্ধ-বঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাতেন। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে পরবর্তী বংশধররা একে একে ভারতের কলকাতায় চলে যায়। এরপর এ রাজবাড়ীতে বিভিন্ন সময় সরকারি অফিস থাকলেও কোনও সংস্কার হয়নি। 

১৮৯৭ সালের ১২ জুন তারিখে এক ভূমিকম্পে রাজবাড়ীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। মূল রাজপ্রাসাদ, সৈন্য ব্যারাক, মালখানা, মন্দির, পুকুর, দেশি-বিদেশি গাছপালাসহ বিশাল পরিধির এ রাজবাড়ীর চত্বর সব ভ্রমণবিলাসকে হাতছানি দেয়। প্রতিবছর শত শত লোক দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নাটোরের রাজবাড়ী ভ্রমণে আসে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.