Header Ads

ফরাসিদের উপহার স্ট্যাচু অব লিবার্টি

বর্তমান বিশ্বে আশ্চর্য যে সকল প্রতিমূর্তি বা সৌধ আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি তার মধ্যে অন্যতম। স্ট্যাচু অব  লিবার্টিকে আমরা প্রায় সবাই জানি এবং চিনি। তবে আমরা অনেকেই হয়তো জানি না এই সৌধ বা প্রতিমূর্তিটা কিভাবে তৈরি হয়েছে বা কারা তৈরি করেছে। সৌধটা যখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত তখন আমরা ভাবতে পারি এই প্রতিমূর্তিটা আমেরিকার তৈরি। কিন্তু তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্মোৎসব পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের জনগণের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন স্মৃতিরক্ষার জন্য স্ট্যাচু অব লিবার্টি বা স্বাধীনতার প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল।

বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ফ্রান্স ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি উপহার দিয়েছিল। আসুন আমরা বিশ্বের বিখ্যাত ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে জানার চেষ্টা করি।

পর্যটন বা দর্শনীয় হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দর্শনীয় বস্তু 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের সমুদ্রের বুকে লিবার্টি নামক দ্বীপে অবস্থিত এই স্থাপনাটি। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী দ্বীপটিতে এসে ভিড় জমায় এই স্থাপনাটি দেখতে। এই স্থাপনাটির প্রকৌশলী ছিলেন ফ্রেডেরিক অগাস্ট বার্থোল্ডি, গুস্তাভ আইফেল ও রিচার্ড মরিস হান্ট। গুস্তাভ আইফেল ছিলেন স্থাপনাটির কাঠামো তৈরির প্রকৌশলী ও রিচার্ড মরিস হান্ট ছিলেন স্থাপনাটির পাদমূল তৈরির প্রকৌশলী। বিখ্যাত এই স্থাপনাটির বিস্তৃতি ১২ একর জায়গা জুড়ে। ফ্রান্সে স্থাপনাটির নির্মাণ শুরু হয় ১৮৭৫ সালে ও নির্মাণ শেষ হয় ১৮৮৪ সালে। আশ্চর্যময় এই স্থাপনাটির নির্মাণ কাহিনী নিয়ে রয়েছে একটি ইতিহাস।

১৮৬৫ সালের এক রাতের কথা। ফরাসি ভাস্কর ফ্রেডেরিক অগাস্ট বার্থোল্ডি ও তার বন্ধু এডওয়ার্ড ডি ল্যাবোলেঁ সেদিন ল্যাবোলেঁর বাড়িতে বসে নৈশভোজ পরবর্তী আড্ডা দিচ্ছিলেন। ওই আড্ডাতেই কথায় কথায় ল্যাবোলেঁ তার একটা গোপন স্বপ্নের কথা বলে ফেলেন বার্থোল্ডিকে।

ব্যক্তিগত জীবনে ল্যাবোলেঁ ছিলেন শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ, এছাড়াও তিনি ছিলেন সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র প্রেমিক। ল্যাবোলেঁর স্বপ্ন ছিল ফরাসি-মার্কিন বন্ধুত্বের চিহ্ন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বড়সড় একটা উপহার দেবেন। যাতে মার্কিনীদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে ফরাসিদের যে বিরাট অবদান সেটাকে তারা আজীবন স্মরণে রাখে।


ল্যাবোলেঁর পরিকল্পনাটা শুনে বার্থোল্ডি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কারণ, তিনিও তো এমন একটা সুযোগ খুঁজছিলেন! বার্থোল্ডির স্বপ্ন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক ছিল না। তিনি বিরাটকায় কোনও একটা স্থাপনা তৈরির সুযোগ খুঁজছিলেন। সম্ভব হলে সেটা কোনও সমুদ্র উপকূলে স্থাপনেরও স্বপ্ন দেখতেন তিনি।


১৮৩৪ সালের ২ আগস্ট ফ্রান্সের কোলমার শহরে জন্ম নেওয়া বার্থোল্ডি চিরদিন বড় বড় স্থাপনার নেশায় কাটিয়েছেন। বয়স ২০ পার হতে না হতেই বিরাট আকারের ভাস্কর্য ও স্থাপনা নির্মাণের স্বপ্ন বার্থোল্ডির পাগলামিতে পরিণত হয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপযুক্ত স্থান ও পৃষ্ঠপোষক খুঁজতে দুনিয়া চষে বেড়িয়েছিলেন তিনি। ১৮৫৬ সালে মিসরে গিয়েছিলেন প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দেখতে। ওই যাত্রা পথে সুয়েজ খাল মনে ধরে গিয়েছিল তার। পরে মিসর সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন সুয়েজ খালের মুখে একটা বিরাট নারীমূর্তি স্থাপনের অনুমতি দিতে। কিন্তু সে প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।


বার্থোল্ডির মনে এরপর দাগ কাটে নিউইয়র্ক শহরের পোতাশ্রয়। ১৮৭১ সালে প্রথম আমেরিকা সফরের সময় শহরটিতে ঢুকতে গিয়েই তার মনে হয়েছিল, এখানে হতে পারে স্বপ্নের সেই স্থাপনা। স্থাপনাটি হবে মশাল হাতে একটি নারীমূর্তি, এমন কল্পনাও করেছিলেন তিনি।


বার্থোল্ডির কল্পনাটা কল্পনাই থেকে যেত। কিন্তু ল্যাবোলেঁর প্রস্তাব শুনে নড়েচড়ে বসলেন বার্থোল্ডি। ভাবলেন এবার তার স্বপ্ন সত্যি হবে। স্বপ্ন অবশ্য এত সহজে সত্যি হলো হয় নি। এই পরিকল্পনার প্রায় ১০ বছর পর ফ্রান্সের সরকার পরিবর্তনের পরই তা সম্ভব হয়েছিল।


যার ওপর স্থাপিত হয়েছে এক বিরাট আকৃতির মহীয়সী নারীমূর্তি। হাতে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার মতো টর্চ। যেটা দেখা যায় সমুদ্রের বহুদূর থেকে। এটা আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতীক মনুমেন্ট। তৈরি হয়েছে তামা ও লোহা দ্বারা। যাকে ১৯২৪ সালে আমেরিকান জাতীয় মনুমেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে। মূর্তিটির মাথার মুকুটের ডান হাতে অনির্বাণ টর্চ। এটি পৃথিবীর মূর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ মূর্তি। যার উচ্চতা ১৫১ ফুট ১ ইঞ্চি এবং মাটি থেকে টর্চ পর্যন্ত উচ্চতা ৩০৫ ফুট ১ ইঞ্চি। টর্চটি জ্বালানো থাকে নিচের বিদ্যুৎ থেকে। এ মনুমেন্টটি তৈরি হয়েছিল ফরাসিদের চিন্তাধারার ওপরে।


ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় নেপোলিয়নের সময় এডওয়ার্ড রিনি লাবুলাই নামে এক
ফরাসি পণ্ডিত প্রথমে প্যারিসে বসে চিন্তা করেন, একটা বিরাট সিভিল ওয়ারে জিতে আমেরিকানরা একটা প্রভূত সম্পদশালী জাতিতে পরিণত হতে চলেছে। তাই ওদের মধ্যে এমন একটা কিছু করা দরকার, যা হবে ফরাসি আমেরিকান মৈত্রীর বন্ধন। তিনি তদানীন্তন একজন বিখ্যাত ভাস্কর বার্থোল্ডির সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেন। ১৮৭১ সালে বার্থোল্ডি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন মনুমেন্টের প্রস্তাব নিয়ে ও স্থান নির্বাচনের জন্য। তিনি সমুদ্র পারের নিউইয়র্ক শহরের বর্তমান দ্বীপটি পছন্দ করেন। 

প্রায় দু'বছর ফরাসি ও আমেরিকান ভাস্কররা এ মূর্তি তৈরিতে শ্রম দেন। একে ৩০০ খণ্ডে তৈরি করা হয় এবং উপর পরে আড়াই মিলিমিটার পুরু তামার শিট জড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৮৮৪ সালে এটা তৈরি সম্পন্ন হলে প্যারিসে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ১৮৮৫ সালে এটি খণ্ড-বিখণ্ড করে টুকরা টুকরা হিসেবে আমেরিকায় পাঠানো হয়। এরপর শুরু হয় সংযোজন পর্ব। নিউইয়র্ক পোতাশ্রয়ের কাছে নির্ধারিত দ্বীপে এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলা পাদমূলের ওপর ধীরে ধীরে জোড়া দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলা হয় স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে।

অবশেষে আসে ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর। অভূতপূর্ব এক লোকসমাগম হয়ে এখানে। ধারণা করা হয় প্রায় ১০ লাখ লোকের সমাবেশ হয়েছিল সেদিন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সেই সব ধনী যারা এই কাজে একটি পয়সাও দেননি, তারাও আসেন উৎসব দেখতে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড উন্মোচন করেন দ্য লেডির মুখ। কিন্তু হায়! এমন দিন আর দেখে যেতে পারলেন না এই স্থাপনার স্বপ্নদ্রষ্টা ল্যাবোলেঁ। কারণ, স্ট্যাচু অব লিবার্টির উদ্বোধনের ৩ বছর আগে ১৮৮৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

প্রতিদিন শত শত পর্যটক এখানে আসেন বিখ্যাত এই স্থাপনাটি দেখতে। ২২তলা উঁচু মূর্তিটির মাথার কাছে পৌছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে দাঁড়াতে হয় পর্যটকদের। মূর্তিটির পাদানিতে কয়েকটি বড় বড় হল রুম আছে। যার মধ্যে আছে মিউজিয়াম। নতুন ইমিগ্র্যান্টদের ছবি এবং পূর্ণ পরিচয়, কিভাবে মূর্তিটি তৈরি হলো ইত্যাদি তথ্য রয়েছে এই মিউজিয়ামে। আরও আছে প্রতিটি তলায় মূর্তিটির বিশিষ্ট অংশ। যেমন মাথা, প্রজ্বলিত টর্চ ইত্যাদি খণ্ড খণ্ড বিরাট মূর্তি ও ছবি। 


১৯৮৬ সালে আবার নতুন করে ফরাসি ও আমেরিকান প্রকৌশলীরা ওটাকে মেরামত করে অংশবিশেষ বদলিয়ে নতুন অংশ লাগিয়ে দেন। প্রজ্বলিত টর্চটাও গোল্ড প্লেটেড কপার ফ্রেম দ্বারা বদলানো হয়। ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর স্ট্যাচু অব লিবার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮৬ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় এর শতবার্ষিকী উদযাপিত হয়। ১৯২৪ সালে এটাকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৬ সালে বেডলুস দ্বীপকে লিবার্টি দ্বীপ বলে নতুন নামকরণ করা হয়। এই স্থাপনাটির তদারকির দায়িত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পার্ক সার্ভিস।

এবার জানা যাক এই বিখ্যাত স্থাপনাটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। এই স্থাপনাটির পাদমূলের উচ্চতা ৮৯ ফুট, পাদমূল থেকে টর্চের উচ্চতা ১৫১ ফুট ১ ইঞ্চি, ভিত্তির পরিমাপ ৬৫ ফুট, মাটি থেকে টর্চের উচ্চতা ৩০৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। প্রতিমূর্তিটির গোড়ালি থেকে মাথার উচ্চতা ১১১ ফুট ৬ ইঞ্চি, হাতের দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট ৫ ইঞ্চি, তর্জনী ৮ ফুট ১ ইঞ্চি, এক কান থেকে আরেক কানের দূরত্ব ১০ ফুট, দুই চোখের দূরত্ব ২ ফুট ৬ ইঞ্চি, নাকের পরিমাপ ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি, কোমর ৩৫ ফুট ও মুখ ৩ ফুট। প্রতিমূর্তিতে ব্যবহৃত হয়েছে তামা ২৭.২২ মেট্রিক টনেও ১১৩.৪ মেট্রিক টন স্টিল। মূর্তিটির মোট ওজন ২০৪.১ মেট্রিক টন। মূর্তির হাতে ধরা বইয়ের দৈর্ঘ্য ২৩ ফুট ৭ ইঞ্চি। বইটি চওড়া ১৩ ফুট ৭ ইঞ্চি ও পুরু ২ ফুট। মূর্তির মুকুটে জানালার সংখ্যা ২৫ ও মুকুটে কাঁটার সংখ্যা ৭টি। যেগুলো দ্বারা সাতটি মহাদেশকে বুঝানো হয়েছে।

শেষ কথায় বলা যায়, স্ট্যাচু অব লিবার্টি আমেরিকানদের দেওয়া ফরাসিদের একটি বড় উপহার। ফরাসিদের স্মরণ রাখা ও মার্কিনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ফরাসিরা এটি যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দিয়েছিল। যার ফল স্বরূপ মার্কিনদের সাথে ফরাসিদের সর্বদা সুসম্পর্ক বজায় আছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.