Header Ads

বৈচিত্রময় ঈদ উল ফিতর (পর্ব-২)

ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সকল মুসলমানের মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতি বছর ঈদ আমাদের মাঝে বাঁকা চাদের হাসি নিয়ে আগমন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে ঈদ উল ফিতর উদযাপিত হয়। তবে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশের কারণে ঈদ একেক দেশে একেকভাবে উদযাপিত হয়।গত পর্বে আমরা বিশ্বের কয়েকটি দেশে ঈদ উল ফিতর পালনের নিয়ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজ আমরা আরও বেশ কয়েকটি দেশের ঈদ উৎসব নিয়ে আলোচনা করবো।

দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ উদযাপন হয়। ইন্দোনেশিয়ায় মাসিক বেতনের সাথে বোনাস প্রদান করা হয়, যাকে বলে তুনজানগান হারি রায়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানরা টানা তিন-চার দিন ধরে ঈদ উৎসব পালন করে থাকে। ছোট বয়স্ক সবাই ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক ক্রয় করে থাকে। ঈদের দিন পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও ঈদের নামাজ আদায় করে। 

ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র সৈকতগুলোতে ঈদের সময় উপচে পড়া ভিড় থাকে। ঈদ উপলক্ষে সমগ্র দেশে আইন শৃঙ্খলা কঠোর করা হয়। জনসাধারণ বড় বড় শহরগুলো যেমন জাকার্তা, সুরাবায়াতে ভিড় করে। শহরের অনেক মানুষ তাদের পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ পালনের জন্য গ্রামে চলে যায়। ইন্দোনেশিয়া সরকারকে প্রতি বছর ঈদের সময় অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয় সড়ক ও ব্রিজ সংস্কার করার কাজে। তারপরও সড়ক ও বিমান বন্দরগুলোতে জনসাধারণের প্রচণ্ড ভিড় থাকে।

মালয়েশিয়া, সিংগাপুর ও ব্রুনাইয়ে ঈদ উৎসবকে হারি রায়া ঈদ ইল ফিতরি বলে। সিংগাপুরের বড় বড় শপিং মলগুলো মানুষে মানুষে পরিপূর্ণ থাকে ঈদ উপলক্ষে। এখানে ঈদ উপলক্ষে সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত বন্ধ থাকে। মালয়েশিয়ায় ঈদের দিনে পুরুষরা সঙ্কোক ও কালো পাগড়ি পরিধান করে থাকে। মালয়েশিয়ার ঘরে ঘরে রান্না হয় বিভিন্ন মজাদার খাবার। যার মধ্যে আছে সামবাল, ডোডল, অপোর, লেমাঙ, জরেং, কেটুপাট ইত্যাদি। রাত শুরুর আগে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার এলাকাগুলো মসজিদের মুয়াজ্জিনের তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। 

রাতে বিভিন্ন স্থানে কুরআনিক ছন্দে রচিত ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ বিভিন্ন সংগীত পরিবেশন করা হয়। এই সংগীতকে কাসিদা বলা হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার পুরুষরা ঈদের দিনে বাজু কোকো নামে এক জাতীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে। এছাড়াও তারা পাশ্চাত্য আদলে স্যুট, ঢিলেঢালা ট্রাউজার ও পিচি হ্যাট পরিধান করে। মহিলারা ঈদের দিনে যে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে তার নাম কিবায়া কুরুং। 

এটা হিজাবের সাথে ঢিলেঢালা এক জাতীয় স্কার্ট বিশেষ। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মুসলমানরা নামাজ শেষ করে কবর স্থানে গমন করে এবং সেখানে আল কুরআন থেকে সূরা ইয়াসিন পাঠ করে। ঈদের দিন মুসলমানরা ওপেন হাউস পালন করে। যার অর্থ এদিনে তাদের বাসায় প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন ও অমুসলমানদের অবাধ আগমন শ্রেয়। বাঁশের মাথায় আলো জ্বালিয়ে ঈদের দিন ালয়েশিয়ানরা বাম্বো ক্যানোন নামে একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পালন করে।

খ্রিষ্টান অধ্যুষিত রাষ্ট্র ফিলিপাইনে ঈদ উৎসবকে ওয়াকাছ নগ রমাদান বলে। বিশ্বের মধ্যে ফিলিপাইনই একমাত্র খ্রিষ্টান রাষ্ট্র যেখানে ঈদের দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা আছে। ফিলিপাইনের মুসলিম অঞ্চলে সর্বপ্রথম উৎসব সহকারে ঈদ পালিত হয়েছিল ২০০২ সালে।

অস্ট্রেলিয়া একটি অমুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে মুসলমানদের বিনা বাধায় ধর্ম পালন করতে দেয়া হয়। বড় বড় মুসলিম অঞ্চলগুলোতে মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করে থাকে। মসজিদে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে। নামাজের সময় ট্রাফিক রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে মুসলমানদের নামাজের ক্বাতার তৈরিতে সাহায্য করে। 

এছাড়াও অস্ট্রেলিয়াতে মুসলমানরা খোলা মাঠ বা ঈদগাহে নামাজ আদায় করে। ঈদের দিনে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে অমুসলমানরা বেড়াতে আসে এবং তাদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। ঈদের দিনে মেলবোর্নে সবচেয়ে বড় ঈদের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার আয়োজন করে থাকে অস্ট্রেলিয়া পুলিশ প্রশাসন। এই মেলার স্টলগুলো বসে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকেন্দ্র থেকে।

মায়ানমারে মুসলমানরা শুধুমাত্র একটি দিন ঈদ উৎসব পালন করতে পারে। সেখানে ঈদের দিনকে ঈদ নেই বা ঈদ কা লে বলা হয়ে থাকে। ঈদের দিন মায়ানমারের মুসলমানরা দুধ ও নারিকেল দিয়ে তৈরি করা এক বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরি করে। রমজানে ছোট ছোট শহর ও গ্রামে মুসলিম বালক ও যুবকরা বিভিন্ন এলাকায় হারমোনিকা বাজানোর মাধ্যমে মানুষদের সাহরী খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে ঢেকে তোলেতাদের এই কর্মকাণ্ডকে জাগো বলা হয়ে থাকে। 

এছাড়াও তারা হিন্দি সুরের অনুকরণে গান পরিবেশন করে, যে গানের বিষয়বস্তু থাকে নামাজ ও রোজ। এই গানকে কাওয়ালী বলা হয়ে থাকে। এই গান ভারত ও পাকিস্তানেও সমান জনপ্রিয়। ঈদ উপলক্ষে মায়ানমারে কোনও সরকারি ছুটির দিন নেই। তবে মুসলমান কর্মকর্তা কর্মচারীরা ইচ্ছা করলে অফিসিয়ালি ছুটি নিতে পারেন। ঈদ উপলক্ষে মুসলমান পরিবারের সদস্যরা নতুন পোশাক পরিচ্ছেদ ও জুতা ক্রয় করে থাকে। 

ঈদের দিন বড়রা ছোটদের অর্থ প্রদান করে থাকে, যাকে বলা হয় ঈদী। ঈদ উপলক্ষে মায়ানমারের অধিবাসীরা তাদের গৃহসমূহকে নানা রংয়ের আলোর বাতি জ্বালিয়ে আলোকময় করে তোলে। মায়ানমারে একটি সাধারণ বিষয় লক্ষ করা যায় সেটি হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে ছেলে মেয়েরা তাদের বন্ধু বান্ধবদের ঈদ কার্ড উপহার দিয়ে থাকে। বর্তমানে ই-কার্ড আরও বেশী জনপ্রিয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় বড় বড় শহরগুলোর ইসলামিক সেন্টার, কনভেনশন সেন্টার ও পার্কগুলোতে। কিছু কিছু শহরে একাধিক ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় অনেক মুসলিমের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। অনেকে ঈদ উপলক্ষে কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ঈদের ছুটি চলাকালে আমেরিকা জুড়ে বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে অনেক লোকের সমাগম ঘটে। এই সকল অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করে ইসলামিক সেন্টার ও ধনী মুসলমানরা। 

ছোটরা ঈদ উপলক্ষে বড়দের নিকট থেকে উপহার সামগ্রী গ্রহণ করে থাকে। সম্পদশালী মুসলমানরা দরিদ্রদের জন্য এদিনে বিশেষ অর্থ প্রদান করে থাকে। হোষ্টোন ও টেক্সাসে বার্ষিক ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় জর্জ ব্রাউন কমিউনিটি সেন্টারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ বিভিন্ন বছরে ঈদ উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকিট উন্মুক্ত করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে বেশীর ভাগ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে আগত। তারা দীর্ঘ দিন ধরে সেখানে বসবাস করে আসছে।

কানাডার ঈদ উৎসব প্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই। সেখানের মুসলমানরা ঈদের দিন বিভিন্ন কনভেনশন সেন্টারে ঈদ উদযাপন করে থাকে। কানাডার মুসলমানরা বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হওয়ার কারণে তাদের মাঝে ঈদ পালনের নিয়ম বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। টরেন্টো, মনটেরাল, ভ্যানকুভার, কালগারি, ওটায়া সহ বড় বড় শহরগুলোতে একাধিক ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানরা তাদের প্রতিবেশী ও পরিচিতদের বাড়িতে ঈদ উপলক্ষে ভ্রমণ করে থাকে। 

ছোট ছোট মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে মুসলমানরা মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টারে ঈদের নামাজ আদায় করে। কানাডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও কমিউনিটি ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ঈদ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। কানাডার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো  ২/৩ দিন ঈদ উপলক্ষে ছুটি পালন করে।

যুক্তরাজ্যে ঈদ উপলক্ষে কোনও সরকারি ছুটির দিন থাকে না। মুসলমান এলাকার অধিবাসীরা সকালে ঈদের নামাজ আদায় করে। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল, কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব স্ব ইচ্ছায় বন্ধ থাকে। সকালে দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক অধিবাসী পুরুষরা জুব্বা ও শেরওয়ানি ও মহিলারা সেলওয়ার কামিজ পরিধান করে থাকে। তারা সেখানে স্থানীয় মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকে। অনেকে ঈদ পালন করার পর স্থানীয় কবরস্থানে যায় এবং সেখানে মৃতদের জন্য দোয়া করে। ঈদের দিনে যুক্তরাজ্যে মুসলমান বাসা-বাড়িতে বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি খাবার তৈরি করা হয়। যার মধ্যে থাকে পোলাও, বিরিয়ানি, সমুচা, সেমাই, ভাত, মাংস ইত্যাদি।

অন্যান্য দেশের মতো চীনেও ঈদ উল ফিতর উদযাপিত হয় আনন্দের সাথে। সেখানের নিনজিয়া ও জিনজিয়াং রাজ্য দুটিতে ঈদ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে। নিনজিয়া প্রদেশে উৎসবের জন্য ছাগলের মাংস বিলি করা হয়। ব্যক্তিগত, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন বাড়িতে ভেড়া ও গরুর মাংস প্রদান করে থাকে। সেখানে ঈদের নামাজ শেষে এক বাসার সদস্যরা অন্য বাসায় বেড়াতে যায়।

ফিজির মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭% মুসলমান। সেখানে যে মুসলমানরা বসবাস করে তার মধ্যে বেশীরভাগ রয়েছে ভারত থেকে আগত। ফিজির মুসলমান পুরুষেরা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে। নামাজের পর সারাদিন ব্যাপী পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন বাসায় অতিথি হিসেবে ঘুরে বেড়ায়। ছোটরা বড়দের নিকট থেকে ঈদ উপহার নিয়ে থাকে। ঈদের দিনে ফিজির সব বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করা হয়। যার মধ্যে থাকে সেমাই, নুডলস, মিষ্টি, সমুচা ইত্যাদি।

সারাবিশ্বের মুসলমানরা ঈদের দিনকে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে। ঈদের দিনের বেশ কিছু কাজ আছে যেগুলো ঐতিহ্যবাহী হিসেবে সকল দেশে একই। যার মধ্যে রয়েছে সকালে গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া, ঈদ উপলক্ষে ছোট বড় সবার নতুন পোশাক পরিধান করা, নামাজ পড়ার আগে সদকা-তুল ফিতরা প্রদান সমাপ্ত করা, মসজিদ বা মাঠে নামাজ আদায় করা, প্রত্যেক বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করা, ছোটদের ঈদ উপহার প্রদান করা, বন্ধু-বান্ধবদের ঈদ কার্ড প্রদান করা, নিকট আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া, প্রত্যেক শহর বা এলাকার প্রসিদ্ধ স্থানে ঘুরতে যাওয়া ও টিভিতে ঈদ উপলক্ষে প্রচারিত বিশেষ অনুষ্ঠান দেখা। এভাবেই প্রতিবছর ঈদ মুসলমানদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসছে অনাবিল সুখ, শান্তি ও আনন্দের পরশ।
এরকম আরও পড়ুন:

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.