Header Ads

আমেরিকার প্রাচীন সব ভুতুড়ে শহরের গল্প

ফুটপাত হীন রাস্তার পাশে ভাঙাচোরা হতশ্রী চেহারার কয়েকটি দালান দাড়িয়ে, ভেতরে আগাছা গজিয়ে গেছে বাড়িগুলোর। বাড়ি এবং রাস্তা দু'জায়গায়ই রং বা প্লাস্টারের বালাই নেই একটা দালানেও। অথচ একশ বছর আগেও এ শহর লোকজনের ব্যস্ত পদচারনায় গমগম করত, এখানে আনাগোনা ছিল স্টেজ কোচ আর দুর্ধর্ষ আউটলদের। কিন্তু এখন আর কেউ নেই, মানুষজন বাস করে না। এমন কোনও শহরে যদি আপনাকে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আপনি কি ভাববেন?

নিশ্চয়ই আপনার গা শিউরে উঠবে আর আপনি ভাববেন আপনাকে কোনও ভূতুড়ে শহরে নিয়ে আসা হয়েছেব্যাপারটি কিন্তু মিথ্যা নয়। এরকম গা ছমছম ভুতুড়ে শহর আমেরিকায় অনেক রয়েছে। আসুন আমরা আমেরিকার এরকম কয়েকটি ভুতুড়ে শহর সম্পর্কে পরিচিত হই।


কলোরাডো:



একটা সময় পশ্চিমের এসব শহরে নানা জায়গা থেকে লোকজন ভিড় জমাত সোনার লোভে। তেমনই একটি শহর কলোরাডো। কলোরাডোর গ্রেগরি টাউনে সোনা আছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার দু'সপ্তাহের মধ্যে সেখানে চার হাজার স্বর্ণ সন্ধানী মাইনার হাজির হয়। অখ্যাত নির্জন শহরটা নিমিষে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তবে এ শহরের জন্ম যেমন ছিল হঠাৎ আবার তেমন মৃত্যুও ছিল তেমনি আকস্মিক। সোনার খনির সমস্ত সম্পদ আহরণের পর মাইনাররা একে একে কেটে পড়লে এক সময়ের ব্যস্ত জনপদ মৃত নগরীতে পরিণত হয়। লোক মুখে প্রচলিত আছে এ শহরে নাকি এখন ভূতের আখড়া। প্রেতাত্মারা নাকি এখানে আসর জমায় এই নগরে।

বোডি:


ক্যালিফোর্নিয়ায় বোডি শহরটি একসময় রাফ এন্ড টাফ' শহর নামে পরিচিত ছিল । আমেরিকার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ আউটলদের আবাস ছিল এই শহরে। ঊন বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এখানে এমন কোনও দিন যায়নি যেদিন এখানে মানুষ খুন হয়নি। ১৮৮০ সালে বোডির বাইরে দুই ডাকাত একটি স্টেজ কোচ লুট করে। যাতে হাজার হাজার ডলারের সোনা ছিল। লুট করার পরে এক সময় দুই ডাকাত ধরা পড়ে এবং তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। তবে তাদের লুট করা সোনার সন্ধান আর পাওয়া যায় নি। কেউ কেউ বলে সেই সোনাগুলো শহরের ধারে কাছে কোথাও মাটি খুড়ে মাটির নিচে ডাকাতরা পুঁতে রেখেছিল। তবে আজও উদ্ধার করা যায়নি সেই সোনাগুলো। 

চারদিকে পাহাড় ঘেরা বোডি শহরটি আক্ষরিক অর্থেই আমেরিকার সবচেয়ে বড় ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বোডি শহরকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন কল্পকথা। লোকে বলে ওখানে সত্যি সত্যিই ভূত আছে। বোডির অভ্যন্তরে নির্জন খাদ থেকে মাঝে মাঝে নাকি উচ্চকিত হাসির আওয়াজ শোনা যায়, দূর থেকে ভেসে আসে গল্প করার আওয়াজ বা শোনা যায় ফিসফিসানির শব্দ। আমেরিকার মানুষেরা যারা এই শহরে গিয়েছে তারা বলে শহরটি থেকে গুরু গম্ভীর পিয়ানো বাজানোর শব্দ দূর থেকে ভেসে আসে। 

মাঝে মাঝে শোনা যায় গানের আওয়াজ। এই শহরে বর্তমানে মানুষজন বাস করে না। ১৮৭০ সালের দিকে শহরে তৈরি করা কাঠের দালানগুলো আজও শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ভয় আর কল্প কাহিনী নিয়ে বোডি আজ আমেরিকার এক ভূতুড়ে শহর।

ভার্জিনিয়া সিটি:


আমেরিকার আরেকটি ভুতুড়ে শহর ভার্জিনিয়া সিটি। সোনার খনির জন্য বিখ্যাত ছিল এ শহরটি আউটলরা এখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকলে এখানে আগমন ঘটেছিল একদল শান্তি রক্ষাকারী মানুষের। তাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল আউটলদের দমন করে শহরে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসা। তারা এখানে এসে আউটলদের সন্ধানে গোটা শহরে চিরুনি অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গণহারে হত্যা করে। 

মন্টানার ভার্জিনিয়া সিটিতে একসময় দশ হাজার লোকের বাস ছিল। কিন্তু সোনার খনি থেকে সোনা ফুরিয়ে গেলে এ শহর ছাড়তে শুরু করে মানুষেরা ফলে শহরের মানুষজন একসময় ফুরিয়ে যায়। এ শহরকে পুরোপুরি মৃত নগরী বলা যাবে না। কারণ এখানে এখনও অন্তত শ দুয়েক মানুষের বসবাস আছে শহরটিকে সরকারিভাবে জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে একটি ওপেন এয়ার মিউজিয়ামও আছে। ঊন বিংশ শতাব্দীর বাড়ি-ঘরগুলো নতুন করে বার্নিশ করা হয়েছে। যা এখানে আসা পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।

রিওলাইট:


আপনি যদি কখনও ডেথ-ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে যান তাহলে একবার নেভাডার রিওলাইট শহর থেকে অবশ্যই ঘুরে আসবেন। ভুতুড়ে এই শহরটিকে নিয়ে এ পর্যন্ত যত ছবি তোলা হয়েছে, আর কোনও শহর নিয়ে এমনটি করা হয়নি। বুনো পশ্চিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর রিওলাইট। রিওলাইট শহরটি মানুষ শূন্য হয়ে মরে ভূত হয়ে যায় যখন সোনার খনি থেকে সোনা উত্তোলনের কাজ শেষ হয়। অর্থাৎ এখানে স্বর্ণ খুঁজতে আসা মাইনাররা এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলখন এই শহর থেকে সোনা তোলা শেষ হয়েছিল। এটি সত্যি একটি ভুতুড়ে শহর। 

শহরটি ক্রমে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সারা শহর মিলে বর্তমানে দর্শনীয় জিনিস বলতে আছে একটি ট্রেন ডিপো এবং একটি বটল হাউস। শহরের বটল হাউসটি একটি অনন্য নিদর্শন। ১৯০৬ সালে মাইনার টম কোলি পঞ্চাশ হাজার বোতল দিয়ে বোতল বাড়িটি তৈরি করেন। বাড়িটির নির্মাণশৈলী সবাইকে অবাক করে দেয়।

সাউথ পাস:


আমেরিকার এই সাউথ পাস শহরে মেয়েরা সৃষ্টি করেছে ইতিহাস উওমিংয়ের সাউথ পাস সিটির আয়ু মাত্র ছয় বছর হলেও শহরটিআছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ১৮৬৯ সালে উওমিং রাজ্যের এক আইনের সংশোধনীতে মেয়েদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। মেয়েদের ভোটাধিকার দেওয়ার ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৭০ সালে সাউথপাস সিটির ইসথার মরিস নামক এক নারী আমেরিকার প্রথম মহিলা বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। 

১৮৭৩ সালের দিকে শহরটি ছেড়ে লোকজন খুব দ্রুত চলে যেতে শুরু করে, ফলে শহরটি একেবারেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে তবে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সোনার লোভে এ শহরে কিছু কিছু মানুষ অভিযান চালিয়েছিল। বর্তমানে সাউথ পাসে সে সময়ের ২৪টির মতো দালান আছে। এই দালান গুলোর মধ্যে একটি আবার জেলখানা।

বার্লিন:


বার্লিন শহরে মানুষ এবং প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী উভয়েই তাদের পদচিহ্ন রেখে গেছে। এক সময়ের ফুলেফেপে ওঠা সিলভার মাইনিং শহর বার্লিন ১৯১১ সাল পর্যন্ত মোটামুটি টিকে ছিল। সতেরো বছর পর শহরের কাছে ইকথিওসার নামে এক ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়। পঞ্চাশ ফুটেরও বেশি লম্বা ইকথিওসার ছিল সামুদ্রিক প্রাণী। ধারনা করা হয় এই ধরনের প্রাণী পৃথিবীতে বাস করত কয়েক লাখ বছর পূর্বে। 

ওই সময় প্রাগৈতিহাসিক সাগরের তলায় ছিল আজকের নেভাডা এবং আমেরিকার বেশির ভাগ অঞ্চল। বার্লিন শহরে অন্তত ৩৭টি ইকথিওসার জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমেরিকার এই শহরটি বর্তমানে 'বার্লিন ইকথিওসার স্টেট পার্ক' নামে সংরক্ষিত করা হয়েছে। বিল্ডিংগুলোর অবস্থা আগের মতো থাকলেও কিছু কিছু ভাঙা জায়গা মেরামত করা হয়েছে। শহর থেকে মাইল দুই দূরে নয়টি ফসিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যা দর্শনার্থীরা আগ্রহের সাথে দর্শন করে থাকে।

টম্বস্টোন:


এরিজোনার টম্বস্টোন শহরের আরেক নাম 'দ্য টাউন টু টাফ টু ডাই। কোনও কালেই এই শহরের আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না, সবসময় গোলাগুলি, মারামারি, রক্তপাত, হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকত। এ শহরের জন্ম মাইনিং ক্যাম্প হিসেবে। এই শহরেও এসেছিল মাইনাররা স্বর্ণ অভিযানে। স্বর্ণ অভিযান শেষে মাইনাররা চলে গেলে টম্বস্টোন আক্ষরিক অর্থেই পরিণত হয় সমাধিস্তম্ভে । এই শহরটিও আমেরিকার একটি ভুতুড়ে শহর হিসেবে পরিচিত। 

তবে এটাকে পুরোপুরি ভুতুড়ে শহর বলা যাবে না। কারণ এখানে এখনও কিছু লোক বাস করছে। ঊন বিংশ শতাব্দীর দালানকোঠা এখনও কিছু স্মৃতি হিসেবে আছে সেখানে। লাইফ সাইজ কিছু ম্যানিকিনও সাজিয়ে রাখা আছে সেখানে গান ফাইটারদের স্মৃতি হিসেবে। যা সবাইকে মনে করিয়ে দেয় তাদের কাহিনীর কথা।

সিলভার সিটি:


আমেরিকার আরেকটি প্রাচীন ভুতুড়ে শহর সিলভার সিটি। মাইনাররা সোনার সন্ধানে এখানে দলে দলে আসলে এটি একটি শহরে পরিণত হয়। সোনা শেষ হয়ে গেলে মাইনাররা এলাকাটি ছেড়ে চলে গেলে এটিও একটি পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হয়। আইডহোর সিলভার সিটিতে আজও নাছোড়বান্দা উৎসাহী কিছু মানুষ মাঝে-মধ্যে সোনা খুঁজতে আসে। 

রাজা আইডহোর ঐতিহাসিক খনি শহর বলে অভিহিত সিলভার সিটিতে একসময় মানুষ মাটি খুঁড়ে ৩০০ পাউন্ড ওজনের আসল রুবির চাঙ পেয়েছিল। বিশাল এই পাথর খণ্ড ১৮৬৭ সালে প্যারিসের প্রদর্শনীতে দেখিয়ে তারা পুরস্কারও জিতেছিল। বর্তমানে পরিত্যক্ত এই শহরে লোকজন নেই বললেই চলে। বর্তমানে মাত্র ৬ জন লোক থাকে এখানে। আর থাকার মধ্যে আছে ৭০টি ঐতিহাসিক সেই সময়ের দালান এবং ওল্ড স্কুল হাউস মিউজিয়াম।  

আপার মিডওয়েস্ট:


বুনো পশ্চিম থেকে মিশিগানের অবস্থান অনেক দূর মনে হলেও একসময় আমেরিকার বৃহত্তম তামার খনি হিসেবে অঞ্চলটি বিখ্যাত ছিল। মিশিগানের উত্তর কিউইনার (Keweenar) পেনিসুলায় কমপক্ষে ৪০০ কপার মাইনিং কোম্পানি একযোগে কাজ করছে। পশ্চিমের শহরগুলোর মতো এখানেও তামার খনির কারণে রাতারাতি বেশ কিছু শহর গজিয়ে উঠে ছিল আবার খনি নিঃশেষ করে মাইনাররা চলে যাওয়ার পরে শহরগুলো পরিত্যক্ত হয়। এর মধ্যে একটি আছে ডেলাওয়ের কপার ঘোস্ট মাইন। শোনা যায়, সেখানে এখন খুঁজলে নাকি তামা পাওয়া যাবে। দর্শনার্থীরা পরিত্যক্ত কুইন্সি মাইন শ্যাপটেও যায়। ১৯৩০ সালে খনিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই খনি থেকে ২ বিলিয়ন পাউন্ড তামা উঠানো হয়েছে।

বর্তমানে আমেরিকায় ঝকঝকে চকচকে শহর থাকলেও এখানে এখনও লুকিয়ে আছে প্রাচীন কিছু শহর। শহরগুলি প্রাচীন ও লোক শুণ্য হওয়ায় এগুলি এখন ভুতের শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানের আলোকোজ্জ্বল শহরগুলোর জন্য আমেরিকানরা যেমন গর্ব করতে পারে তেমনি তারা গর্ব করতে পারে এই প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহরগুলোর জন্যেও। কারণ, এগুলো মানব সভ্যতার এক নিদর্শন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.